আজ থেকে ঠিক আট বছর আগে, ২০১৭ সালের ১লা জুলাই মধ্যরাতে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। এই দিনই চালু হয়েছিল বহু প্রতীক্ষিত পণ্য ও পরিষেবা কর বা GST (Goods and Services Tax)। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে ‘এক দেশ, এক কর’ নীতি বাস্তবায়নের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন। জিএসটি চালুর ৮ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদী X (পূর্বতন টুইটার)-এ এক পোস্টে লেখেন, ‘‘জিএসটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে রূপান্তর করেছে এবং সহজে ব্যবসা করার পরিবেশকে আরও মজবুত করেছে, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলির জন্য।’’
প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেছেন, ‘‘জিএসটি ভারতের বাজারকে একত্রিত করতে রাজ্যগুলিকে সমান অংশীদার হিসেবে যুক্ত করেছে। এটি প্রকৃত অর্থে সমবায় ফেডারালিজমের এক উদাহরণ।’’
জিএসটি-এর ধারণা প্রথমবার সামনে আসে ২০০০ সালে, যখন অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে এই কর সংস্কার নিয়ে আলোচনার জন্য। তবে রাজনৈতিক জটিলতা, রাজ্যগুলির আপত্তি এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের কারণে বিষয়টি প্রায় দুই দশক স্থগিত ছিল। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ধারণা আবারও নতুন করে আলোচনায় আসে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনার পর ২০১৬ সালে সংসদে ১২২তম সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। এই বিলটির মাধ্যমে কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়কেই কর আরোপের ক্ষমতা দেয়া হয়, যা একটি অভিন্ন কর ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে।
জিএসটি-এর মূল উদ্দেশ্য
জিএসটি চালুর মূল লক্ষ্য ছিল এক জটিল কর ব্যবস্থাকে সহজতর করা। এর আগে ভারতে ভ্যাট, এক্সসাইজ ডিউটি, সার্ভিস ট্যাক্স, এন্ট্রি ট্যাক্সসহ নানা ধরনের পরোক্ষ কর ছিল। এই ভিন্ন ভিন্ন কর ব্যবস্থার কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য কমপ্লায়েন্স ব্যয় ও জটিলতা অনেক বেশি ছিল। জিএসটি এই সব কর একত্র করে একটি একক কর কাঠামো তৈরি করে। ফলে বহুজাতীয় এবং দেশীয় ব্যবসায়ীরা সহজভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছেন এবং একইসঙ্গে ট্যাক্সের ওপর দ্বিগুণ ধার্য হওয়ার ঝুঁকি কমেছে।
জিএসটি-র মাধ্যমে করের ‘ক্যাসকেডিং ইফেক্ট’ বা পরপর করের প্রভাব দূর করা হয়েছে। এটি পণ্য ও পরিষেবার খরচ কমিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্যও সুবিধা বয়ে এনেছে।
সহজ ব্যবসা এবং রাজস্ব বৃদ্ধি
প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতে, জিএসটি কার্যকর হওয়ার ফলে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা সহজ করার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং ক্ষুদ্রতম উদ্যোগ (MSME) খাত সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে রাজস্ব সংগ্রহে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও ধীরে ধীরে জিএসটি সংগ্রহ স্থিতিশীল হয়েছে এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চলতি বছরে বিভিন্ন মাসে জিএসটি সংগ্রহ এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা সরকারের জন্য বড় সাফল্য।
সমবায় ফেডারালিজমের এক দৃষ্টান্ত
জিএসটি চালুর আরেকটি বড় দিক হলো কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয়। আগে রাজ্য ও কেন্দ্র পৃথক পৃথকভাবে পরোক্ষ কর আরোপ করত, ফলে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দিত। জিএসটি এই ব্যবধান কমিয়ে এনে রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়কেই কর ভাগাভাগি করার সুযোগ দিয়েছে। জিএসটি কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিরা এই ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণে সরাসরি যুক্ত থাকে, যা ভারতের ফেডারেল কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করেছে।
চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
যদিও জিএসটি অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো আছে। প্রথম দিকে প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা জিএসটি নেটওয়ার্কে ফাইলিং এবং রিটার্ন জমা দিতে সমস্যায় পড়েছিলেন। এছাড়াও, একাধিক কর স্ল্যাব থাকা, বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভিন্ন হারে কর আরোপ, এবং মধ্যবর্তী সময়ে নীতি পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। তবে সরকারের দাবি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যাগুলো কমিয়ে আনা হয়েছে এবং নীতি আরও সহজতর করা হচ্ছে।
সামনের দিক
জিএসটি চালুর আট বছর পরে সরকার এখন আরও সরলীকরণের দিকে এগোচ্ছে। একাধিক কর স্ল্যাবের সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা আছে, যাতে কর কাঠামো আরও স্পষ্ট এবং সহজ হয়। ডিজিটাল পদ্ধতি আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে, যাতে ব্যবসায়ীরা দ্রুত এবং ঝামেলাহীনভাবে কর সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর কথায়, ‘‘জিএসটি শুধুমাত্র এক কর ব্যবস্থা নয়, এটি ভারতের অর্থনৈতিক একীকরণের প্রতীক।’’ আজ আট বছর পরও এই সংস্কার দেশীয় অর্থনীতি এবং ব্যবসায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর এই যাত্রায় দেশের প্রত্যেকটি রাজ্যের সমান অংশীদারিত্ব এক নতুন ভারতের আত্মপ্রকাশের বার্তা বহন করছে।