মিলন পণ্ডা, তমলুক: পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এগরা (Egra) ১ নম্বর ব্লকের সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি পরিচালিত প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পুষ্পরানী মাইতি ও তাঁর স্বামী মনোরঞ্জন মাইতির বিরুদ্ধে এক ঠিকাদারকে কাটমানি দাবি এবং টেন্ডার বাতিলের জন্য হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় ঠিকাদার চন্দন গুছাইত এগরা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। তবে, বিজেপি পক্ষ থেকে এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে এবং ঠিকাদারের বিরুদ্ধে পাল্টা আর্থিক তছরুপ ও চরিত্রহীনতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই ঘটনা সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে যায়। এই পঞ্চায়েতের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন পুষ্পরানী মাইতি (সাহু)। সম্প্রতি, সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট (সিএসপি) খোলার জন্য একটি টেন্ডার প্রকাশিত হয়। এই টেন্ডারের জন্য আবেদন করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পেশায় ঠিকাদার চন্দন গুছাইত। তবে, ঠিকাদারের অভিযোগ, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পুষ্পরানী মাইতি তাকে টেন্ডার বাতিল করার জন্য চাপ দেন এবং লিখিতভাবে পঞ্চায়েতে জানিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। চন্দন গুছাইত এতে রাজি না হওয়ায় প্রধান ও তাঁর স্বামী ফোনে হুমকি দেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, টেন্ডার বাতিল না করলে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মারধর করা হবে এবং প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
চন্দন গুছাইত এগরা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে জানান, “আমি সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারি টেন্ডারের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েতের প্রধান পুষ্পরানী মাইতি ফোন করে টেন্ডার তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেন। আমি কাটমানি দিতে অস্বীকার করায় তিনি ও তাঁর স্বামী মনোরঞ্জন মাইতি আমাকে ফোনে ধমক দিয়েছেন। তারা বলেছেন, টেন্ডার না তুললে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মারধর করা হবে। আমি এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। এই বিষয়ে থানা, ব্লক এবং পঞ্চায়েত স্তরে অভিযোগ জানিয়েছি।”
এই ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব বিজেপি পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এগরার বিধায়ক তথা কাঁথি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের সভাপতি তরুণ কুমার মাইতি বলেন, “সরকারি টেন্ডারের ক্ষেত্রে বিজেপি পঞ্চায়েত প্রধান ও তাঁর স্বামী ঠিকাদারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন। এই অভিযোগ গুরুতর। বিজেপি নেতৃত্ব সব সময় তৃণমূলকে চোর বলে অভিযোগ করে, কিন্তু এখন তাদের নিজেদের দিকে তাকানো উচিত। আমরা আশা করি, বিজেপি তাদের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেবে। পুলিশ প্রশাসন এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করবে।”
অন্যদিকে, বিজেপি পক্ষ থেকে এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে। সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পুষ্পরানী মাইতি বলেন, “গ্রামবাসীরা গণস্বাক্ষর করে আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন যে, চন্দন গুছাইত একজন গৃহবধূ ও তার সন্তানকে নিয়ে পালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এমন একজন ব্যক্তিকে কি সিএসপি টেন্ডার দেওয়া উচিত? গ্রামের মানুষ, বিধায়ক এবং অন্যান্যরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। চন্দন গুছাইত তৃণমূলের ক্যাডার এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
মেদিনীপুর সাংগঠনিক জেলার বিজেপি সম্পাদক সিদ্ধেশ্বর মহাপাত্র বলেন, “চন্দন গুছাইত দীর্ঘদিন ধরে চরিত্রহীন ও দুষ্কৃতী হিসেবে পরিচিত। তিনি চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। তার পরিবারও তাকে সমর্থন করে না। সাহাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে ২৫ জন ঠিকাদার কাজ করেন, কিন্তু কেউ প্রধানের বিরুদ্ধে কাটমানি চাওয়ার অভিযোগ করেননি। প্রধান নিষ্ঠার সঙ্গে পঞ্চায়েত পরিচালনা করছেন।”
এগরা থানার এক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, “অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে। তদন্তের ফলাফলের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।” এই ঘটনা স্থানীয় রাজনীতিতে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্ব বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানালেও, বিজেপি পক্ষ থেকে এটিকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুরের রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি সরকারি কাজে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এবং ঠিকাদারদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে, বিজেপি দাবি করছে যে, তৃণমূল ষড়যন্ত্র করে তাদের বদনাম করার চেষ্টা করছে। এই ঘটনার তদন্তে পুলিশ কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে।
এই ধরনের অভিযোগ ভারতের গ্রামীণ প্রশাসনে দুর্নীতির একটি বড় সমস্যাকে তুলে ধরে। সরকারি টেন্ডারে স্বচ্ছতা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা হয়। এই ঘটনার তদন্তের ফলাফল এবং পুলিশের পদক্ষেপের দিকে সবার নজর রয়েছে।