পিএম-কিষাণ যোজনায় প্রকৃত কৃষকদের কতটা সাহায্য পৌঁছাচ্ছে?

ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি যোজনা (PM-Kisan Yojana) কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর চালু হওয়া এই কেন্দ্রীয়…

PM-Kisan Yojana 2025: Are Real Farmers Getting Enough Support?

ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি যোজনা (PM-Kisan Yojana) কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর চালু হওয়া এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রদানের লক্ষ্যে বার্ষিক ৬,০০০ টাকা সরাসরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। এই অর্থ তিনটি সমান কিস্তিতে (প্রতি চার মাসে ২,০০০ টাকা) প্রদান করা হয়। ২০২৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯তম কিস্তি মুক্তি পেয়েছে, যার মাধ্যমে প্রায় ৯.৮ কোটি কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২২,০০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে, প্রশ্ন উঠছে—এই প্রকল্পটি কি প্রকৃত কৃষকদের পর্যাপ্ত সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে, নাকি এর বাস্তবায়নে এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে?

পিএম-কিষাণ যোজনার উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য
পিএম-কিষাণ যোজনার মূল লক্ষ্য হলো ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি ও গৃহস্থালি খরচের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এই প্রকল্পের অধীনে, কৃষক পরিবারগুলি (স্বামী, স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান) যারা চাষযোগ্য জমির মালিক, তারা এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। প্রাথমিকভাবে এটি দুই হেক্টর পর্যন্ত জমির মালিক কৃষকদের জন্য ছিল, কিন্তু ২০১৯ সালের জুন থেকে এটি সমস্ত জমির মালিক কৃষকদের জন্য প্রসারিত করা হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। আয়কর প্রদানকারী, সরকারি কর্মচারী, ১০,০০০ টাকার বেশি পেনশনভোগী এবং প্রাতিষ্ঠানিক জমির মালিকরা এই প্রকল্পের আওতায় পড়েন না। অর্থ সরাসরি ডিবিটি (ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে, যা স্বচ্ছতা এবং দ্রুততা নিশ্চিত করে।

   

২০২৫ সালের হিসাবে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ কোটিরও বেশি কৃষকের কাছে ৩.৪৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিতরণ করা হয়েছে। ২০২৫ সালের জুন-জুলাইয়ে ২০তম কিস্তি প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রায় ৯ কোটি কৃষকের কাছে পৌঁছাবে। তবে, এই প্রকল্পের সাফল্য সত্ত্বেও, প্রকৃত কৃষকদের কাছে এর সুবিধা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

প্রকৃত কৃষকদের কাছে সাহায্য পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ
পিএম-কিষাণ যোজনা যদিও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত, তবুও এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, যোগ্য কৃষকদের চিহ্নিতকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সরকারগুলির উপর যোগ্য কৃষকদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অসম্পূর্ণ জমির রেকর্ড এবং প্রশাসনিক বাধার কারণে অনেক যোগ্য কৃষক এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবে গত বছরের তুলনায় ৪৫% সুবিধাভোগী কমেছে, মহারাষ্ট্রে ১১.৫% এবং উত্তর প্রদেশে ১৬.৫% হ্রাস পেয়েছে। এই হ্রাসের পেছনে জমির রেকর্ডের সমস্যা এবং ই-কেওয়াইসি প্রক্রিয়ার জটিলতা প্রধান কারণ।

দ্বিতীয়ত, ই-কেওয়াইসি প্রক্রিয়াটি অনেক কৃষকের জন্য একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ই-কেওয়াইসি সম্পন্ন না করলে কৃষকরা কিস্তি পান না। গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল অ্যাক্সেসের অভাব এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব এই প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তুলেছে। তৃতীয়ত, অনেক কৃষক মনে করেন যে বার্ষিক ৬,০০০ টাকা তাদের কৃষি ও গৃহস্থালি চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং কৃষি উৎপাদনের খরচের প্রেক্ষিতে। সমালোচকরা বলছেন যে এই পরিমাণ অপ্রতুল এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য ও কৃষি সংকট সমাধানে সীমিত প্রভাব ফেলছে।

Advertisements

কৃষকদের প্রতিক্রিয়া
অনেক কৃষক এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ থাকলেও, তাদের মধ্যে কিছু অসন্তোষ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের একজন কৃষক, অজয় মণ্ডল (ছদ্মনাম), বলেন, “৬,০০০ টাকা আমাদের বীজ, সার এবং শ্রমের খরচের তুলনায় খুবই কম। তবুও, এটি কিছুটা সাহায্য করে। কিন্তু ই-কেওয়াইসি এবং জমির রেকর্ডের সমস্যার কারণে অনেকে এই সুবিধা পাচ্ছেন না।” উত্তর প্রদেশের আরেকজন কৃষক, রামেশ্বর যাদব (ছদ্মনাম), বলেন, “আমার গ্রামে অনেক কৃষকের আধার কার্ড ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে লিঙ্ক করা নেই, ফলে তারা এই টাকা পাচ্ছেন না।”

সরকারের প্রচেষ্টা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পিএম-কিষাণ পোর্টাল (pmkisan.gov.in) এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা অনলাইনে নিবন্ধন, ই-কেওয়াইসি এবং সুবিধাভোগীর তালিকা পরীক্ষা করতে পারেন। কমন সার্ভিস সেন্টার (সিএসসি) এবং স্থানীয় রাজস্ব কর্মকর্তারা নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এছাড়া, পিএম-কিষাণ মানধন যোজনার মাধ্যমে কৃষকদের জন্য ৬০ বছর বয়সের পর মাসিক ৩,০০০ টাকা পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা ২৩.৩৮ লক্ষ কৃষক গ্রহণ করেছেন।

২০২৫ সালের বাজেটে পিএম-কিষাণের জন্য ৬০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিছু কৃষক এবং অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন যে ভবিষ্যতে এই পরিমাণ বাড়িয়ে ৯,০০০ বা ১২,০০০ টাকা করা হতে পারে। তবে, এই ধরনের বৃদ্ধি অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমির রেকর্ড ডিজিটাইজেশন এবং ই-কেওয়াইসি প্রক্রিয়া সহজ করা হলে আরও কৃষক এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন।

পিএম-কিষাণ যোজনা ভারতের কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। তবে, অসম্পূর্ণ জমির রেকর্ড, ই-কেওয়াইসি জটিলতা এবং অপ্রতুল আর্থিক সহায়তার কারণে অনেক প্রকৃত কৃষক এখনও পুরোপুরি উপকৃত হচ্ছেন না। সরকারের উচিত এই চ্যালেঞ্জগুলি দ্রুত সমাধান করা এবং অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে বিবেচনা করা। কৃষকদের জীবনমান উন্নত করতে এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো প্রয়োজন।