কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের মধ্যে অষ্টম বেতন কমিশনের (8th Pay Commission)বিলম্ব নিয়ে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা করলেও, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই কমিশনের আনুষ্ঠানিক গঠন বা এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের নিয়োগ এবং কার্যপরিধি (Terms of Reference – ToR) চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রেও কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। এই বিলম্বের ফলে প্রায় ৩৫ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৭ লক্ষ পেনশনভোগীদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই এই বিলম্বকে সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছেন।
কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের ক্ষোভের কারণ
সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৬ সালে কার্যকর হয়েছিল, এবং এর মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হচ্ছে। সাধারণত, প্রতি দশ বছর অন্তর বেতন কমিশন গঠন করা হয়, এবং কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা আশা করছিলেন যে অষ্টম বেতন কমিশন ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, কমিশনের গঠন এবং এর সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগতে পারে। ফলে, বেতন ও পেনশন সংশোধন ২০২৭ বা ২০২৮ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারে। এই দীর্ঘ বিলম্ব কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের প্রধান কারণ।
কর্মচারী ইউনিয়ন এবং পেনশনভোগী সংগঠনগুলি এই বিলম্বের জন্য সরকারের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করছে। ভারত পেনশনভোগী সমাজ (BPS) এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল-জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (NC-JCM) সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, সরকারের ঘোষণার পর ছয় মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কমিশনের গঠন বা ToR চূড়ান্ত হয়নি, যা কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। এই বিলম্বের ফলে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা কর্মচারীদের মনোবলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কর্মচারীদের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে এই বিলম্ব নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অনেক কর্মচারী মনে করছেন, সরকার তাদের প্রতি অবিচার করছে। একজন কেন্দ্রীয় কর্মচারী, রমেশ কুমার (ছদ্মনাম), বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করছি, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে আমাদের বেতন মেলেনি। অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণায় আমরা আশান্বিত ছিলাম, কিন্তু এখন এই বিলম্ব আমাদের হতাশ করেছে।”
পেনশনভোগীরাও একইভাবে ক্ষুব্ধ। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, শান্তি দেবী (ছদ্মনাম), বলেন, “আমাদের পেনশনের পরিমাণ এখনকার মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা ভেবেছিলাম অষ্টম বেতন কমিশন আমাদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়।”
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি এই বিষয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। অল ইন্ডিয়া স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে একটি জাতীয় আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা অষ্টম বেতন কমিশনের দ্রুত গঠন এবং পুরনো পেনশন স্কিম (OPS) পুনর্বহালের দাবি জানাবে।
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ
বিলম্বের পেছনে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কিছু কারণ রয়েছে। সরকারকে কল্যাণমূলক প্রকল্প, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে। একটি উদার বেতন বৃদ্ধি সরকারের অর্থনৈতিক বোঝা বাড়িয়ে তুলতে পারে। এছাড়া, কমিশনের ToR চূড়ান্ত করতে এবং উপযুক্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ করতে সময় লাগছে। ঐতিহাসিকভাবে, পূর্ববর্তী বেতন কমিশনগুলির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লেগেছে। সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয়েছিল। এই নজির অনুসারে, অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ ২০২৭ সালের আগে কার্যকর হওয়া কঠিন।
কর্মচারীদের প্রত্যাশা ও সম্ভাব্য ফলাফল
কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা আশা করছেন যে অষ্টম বেতন কমিশন বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাতা, পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে থাকতে পারে, যা ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে ৪০,০০০ থেকে ৫১,০০০ টাকায় উন্নীত করতে পারে। এছাড়া, মহার্ঘ ভাতা (DA) মূল বেতনের সঙ্গে একীভূত করা এবং পেনশন সংশোধনের সময়কাল ১৫ বছর থেকে কমিয়ে ১২ বছর করার প্রস্তাবও রয়েছে।
তবে, এই সব পরিবর্তন কার্যকর হওয়ার আগে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। NC-JCM ইতিমধ্যেই একটি স্মারকলিপি তৈরির কাজ শুরু করেছে, যেখানে ন্যূনতম মজুরি, ভাতা, পদোন্নতি নীতি এবং পেনশন সুবিধার বিষয়ে দাবি উত্থাপন করা হবে। এই স্মারকলিপি জুন ২০২৫-এ চূড়ান্ত হওয়ার কথা।
অষ্টম বেতন কমিশনের বিলম্ব কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের মধ্যে গভীর হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। সরকারের ঘোষণা সত্ত্বেও, কমিশনের গঠন ও সুপারিশ বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্ব কর্মচারীদের প্রত্যাশার উপর প্রভাব ফেলছে। কর্মচারী ইউনিয়ন এবং পেনশনভোগী সংগঠনগুলির চাপ এবং সম্ভাব্য আন্দোলন সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে। তবে, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের কারণে এই প্রক্রিয়া জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেয় এবং কর্মচারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনে।