ব্যক্তিগত ঋণ (Personal Loan) বর্তমানে ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য জরুরি আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। হোক চিকিৎসার খরচ, শিক্ষার জন্য অর্থ, বা বিয়ের আয়োজন—ব্যক্তিগত ঋণ অনেকের জন্য সহজ সমাধান। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আবেদনকারীদের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে। এর পেছনে থাকে কিছু সাধারণ ভুল, যা সঠিকভাবে এড়ানো গেলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব, কেন আপনার ব্যক্তিগত ঋণ প্রত্যাখ্যান হয় এবং ২০২৫ সালে কীভাবে এই ভুলগুলি এড়িয়ে আর্থিক পরিকল্পনা সফল করা যায়।
ব্যক্তিগত ঋণ প্রত্যাখ্যানের সাধারণ কারণ
ব্যাংক বা নন-ব্যাংকিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (NBFC) ঋণ মঞ্জুর করার আগে আবেদনকারীর আর্থিক প্রোফাইল যাচাই করে। এই প্রক্রিয়ায় কিছু সাধারণ ভুল আবেদন প্রত্যাখ্যানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিচে এই ভুলগুলির বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. নিম্ন ক্রেডিট স্কোর
ক্রেডিট স্কোর ব্যক্তিগত ঋণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত ৭৫০ বা তার বেশি ক্রেডিট স্কোর থাকলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু অনেকে নিয়মিত ঋণ বা ক্রেডিট কার্ডের কিস্তি পরিশোধ না করার কারণে তাঁদের ক্রেডিট স্কোর কমে যায়। শ্যামল দাস, একজন কলকাতার বাসিন্দা, বলেন, “আমি গত বছর একটি ব্যক্তিগত ঋণের জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু আমার ক্রেডিট স্কোর ৬৫০ ছিল বলে তা প্রত্যাখ্যান হয়।” ক্রেডিট স্কোর উন্নত করতে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ এবং অপ্রয়োজনীয় ঋণ এড়ানো জরুরি।
২. অসম্পূর্ণ বা ভুল ডকুমেন্ট
ঋণের আবেদন প্রক্রিয়ায় সঠিক ডকুমেন্ট জমা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, এবং বেতনের প্রমাণপত্রের মতো নথিগুলি সঠিক এবং আপডেটেড হওয়া উচিত। অনেক সময় ভুল তথ্য বা অসম্পূর্ণ নথির কারণে আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়। উদাহরণস্বরূপ, আবেদনকারী যদি ভুল ঠিকানা বা পুরানো ব্যাংক স্টেটমেন্ট জমা দেন, তবে ব্যাংক তা গ্রহণ করবে না।
৩. উচ্চ ঋণ-আয় অনুপাত (DTI)
ঋণ-আয় অনুপাত (Debt-to-Income Ratio) ব্যাংক বা NBFC-এর কাছে আবেদনকারীর ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নির্ধারণ করে। যদি আবেদনকারীর মাসিক আয়ের তুলনায় ঋণের কিস্তি বেশি হয়, তবে ঋণ প্রত্যাখ্যান হতে পারে। সাধারণত, DTI ৪০%-এর নিচে থাকা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো মাসিক আয় ৫০,০০০ টাকা হয় এবং তিনি ইতিমধ্যে ২৫,০০০ টাকার কিস্তি পরিশোধ করেন, তবে নতুন ঋণ পাওয়া কঠিন হবে।
৪. একাধিক ঋণের আবেদন
অনেকে একই সময়ে একাধিক ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেন, যা তাঁদের ক্রেডিট প্রোফাইলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাংক এটিকে আর্থিক অস্থিরতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে। ফিনান্সিয়াল প্ল্যানার রাহুল সেন বলেন, “একসঙ্গে অনেকগুলো ঋণের আবেদন করলে ব্যাংক মনে করে আবেদনকারী আর্থিক সংকটে আছেন। তাই একবারে একটি ব্যাংকে আবেদন করা উচিত।”
৫. অস্থির চাকরি বা আয়
ব্যাংক সাধারণত স্থিতিশীল আয়ের উপর ভরসা করে ঋণ মঞ্জুর করে। যদি আবেদনকারীর চাকরির স্থায়িত্ব কম থাকে বা তিনি ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন করেন, তবে ঋণ প্রত্যাখ্যানের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া, স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিয়মিত আয়ের প্রমাণ জরুরি।
এই ভুলগুলি কীভাবে এড়ানো যায়?
২০২৫ সালে ব্যক্তিগত ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
• ক্রেডিট স্কোর উন্নত করুন: নিয়মিত ক্রেডিট কার্ড বিল এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ করুন। ক্রেডিট ব্যুরো (CIBIL, Equifax) থেকে নিয়মিত আপনার স্কোর চেক করুন। ক্রেডিট স্কোর ৭৫০ বা তার বেশি হলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
• সঠিক ডকুমেন্ট জমা দিন: আবেদনের আগে প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, এবং আয়ের প্রমাণপত্র যাচাই করে নিন। সব নথি আপডেটেড এবং সঠিক হওয়া উচিত।
• DTI কমানো: বিদ্যমান ঋণের কিস্তি কমিয়ে আনুন। প্রয়োজনে ছোট ঋণগুলো আগে পরিশোধ করুন, যাতে DTI কম থাকে।
• একাধিক আবেদন এড়ানো: একবারে একটি ব্যাংক বা NBFC-তে আবেদন করুন। ঋণ প্রত্যাখ্যান হলে ৩-৬ মাস অপেক্ষা করে আবার আবেদন করুন।
• স্থিতিশীল আয় নিশ্চিত করুন: চাকরির স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরি ধরে রাখুন। স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত আয়ের প্রমাণ হিসেবে ITR ফাইল করুন।
আর্থিক পরিকল্পনার গুরুত্ব
ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার আগে সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবেদনকারীদের তাঁদের মাসিক বাজেট এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা মূল্যায়ন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, বাজাজ ফিনসার্ভ, HDFC ব্যাংক, এবং ICICI ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান ঋণের কিস্তি ক্যালকুলেটর প্রদান করে, যা আবেদনকারীদের মাসিক কিস্তি এবং সুদের হার বুঝতে সাহায্য করে। এছাড়া, ঋণের পরিমাণ এবং মেয়াদ সঠিকভাবে নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া আর্থিক চাপ বাড়াতে পারে।
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ
ভারত সরকার এবং ব্যাংকগুলো আর্থিক সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে অনলাইন ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। এছাড়া, ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কাউন্সেলিং পরিষেবা প্রদান করে, যা আবেদনকারীদের সঠিক পথ দেখায়। তবে, আবেদনকারীদের সচেতন হওয়া উচিত যে, উচ্চ সুদের হার বা লুকানো ফি সংক্রান্ত শর্তাবলী ভালোভাবে পড়ে নেওয়া জরুরি।
ব্যক্তিগত ঋণ প্রত্যাখ্যানের পেছনে সাধারণ ভুলগুলি এড়িয়ে গেলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ক্রেডিট স্কোর উন্নত করা, সঠিক ডকুমেন্ট জমা দেওয়া, DTI কমানো, এবং স্থিতিশীল আয় নিশ্চিত করা ঋণ আবেদনের সাফল্যের চাবিকাঠি। ২০২৫ সালে আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ভুলগুলি এড়িয়ে আপনি আপনার আর্থিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। তাই, ঋণের জন্য আবেদন করার আগে আপনার আর্থিক প্রোফাইল পরীক্ষা করুন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এই সতর্কতা আপনাকে আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।