অবসর জীবন মানে শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আর্থিক নিরাপত্তার সময়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত নিম্নপদস্থ কর্মচারী (এলডিসি) এই স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কলকাতার শ্যামল চক্রবর্তী (নাম পরিবর্তিত), একজন অবসরপ্রাপ্ত এলডিসি, যিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেনশন সংস্কারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। অষ্টম বেতন কমিশনের (8th Pay Commission) ঘোষণার পর তাঁর মতো বহু অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আশায় বুক বেঁধেছেন, কিন্তু আর্থিক সংকট এবং পেনশন সংস্কারের বিলম্ব তাঁদের জীবনে নিয়ে এসেছে অন্ধকার। এই প্রতিবেদনে আমরা শ্যামলের আবেগঘন গল্প এবং পেনশন সংস্কারের প্রত্যাশার বিষয়ে আলোকপাত করছি।
শ্যামলের গল্প: একজন এলডিসির জীবন
শ্যামল চক্রবর্তী, বয়স ৬৮ বছর, ৩৫ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি বিভাগে নিম্নপদস্থ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে অবসর নেওয়ার পর তাঁর জীবনের সঞ্চয় এবং পেনশনই ছিল তাঁর একমাত্র আর্থিক সহায়। বর্তমানে তিনি মাসে ১২,০০০ টাকা পেনশন পান, যা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। শ্যামল বলেন, “আমার স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ, বাড়ির ভাড়া, এবং দৈনন্দিন খরচ মেটাতে এই পেনশন যথেষ্ট নয়। প্রতি মাসে আমি ঋণের বোঝা বাড়তে দেখছি।” তাঁর এই গল্প শুধু তাঁর একার নয়, বরং হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত এলডিসি এবং অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর জীবনের বাস্তব চিত্র।
অষ্টম বেতন কমিশনের প্রত্যাশা
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা করেছে, যা ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এই কমিশনের লক্ষ্য কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীদের বেতন ও পেনশন পুনর্গঠন করা। শ্যামলের মতো অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা আশা করছেন, এই কমিশন তাঁদের পেনশন বাড়াবে এবং পুরাতন পেনশন স্কিম (ওপিএস) ফিরিয়ে আনার দাবি পূরণ করবে। বর্তমানে, নতুন পেনশন স্কিম (এনপিএস) এর অধীনে পেনশন নির্ভর করে বাজারের কর্মক্ষমতার উপর, যা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। শ্যামল বলেন, “ওপিএস ফিরলে আমরা নিশ্চিত পেনশন পাব। এটি আমাদের শেষ জীবনের একমাত্র ভরসা।”
আর্থিক সংকটের চিত্র
শ্যামলের মতো অবসরপ্রাপ্ত এলডিসিরা মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে লড়াই করছেন। খাদ্য, চিকিৎসা, এবং গৃহস্থালির খরচ গত দশকে ৮-১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর স্ত্রীর ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৫,০০০ টাকা খরচ হয়। এছাড়া, বাড়ির ভাড়া এবং দৈনন্দিন খরচ মিলিয়ে তাঁর পেনশনের অর্ধেকেরও বেশি চলে যায়। তিনি বলেন, “আমার ছেলে চাকরি করে, কিন্তু তার নিজের সংসার আছে। আমি তাকে বোঝা হতে চাই না।” এই অবস্থায়, অষ্টম বেতন কমিশন তাঁর জন্য একটি আশার আলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টম বেতন কমিশন পেনশন বৃদ্ধির জন্য ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ থেকে ৩.৬৮ এর মধ্যে নির্ধারণ করতে পারে। এর ফলে ন্যূনতম পেনশন ৯,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫,৭৪০ টাকা হতে পারে। তবে, এই সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্বের আশঙ্কা রয়েছে, কারণ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্য নিয়োগ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
পুরাতন পেনশন স্কিমের দাবি
শ্যামলের মতো অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী পুরাতন পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছেন। ওপিএস-এর অধীনে, পেনশন ছিল শেষ বেতনের ৫০% এবং নিয়মিত মহার্ঘ ভাতা (DA) সংযোজনের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হতো। কিন্তু এনপিএস-এর অধীনে, পেনশন বাজারের ঝুঁকির উপর নির্ভর করে, যা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। শ্যামল বলেন, “আমার বয়সে বাজারের ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য নেই। ওপিএস ফিরলে আমরা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারব।” পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সংগঠনগুলো ওপিএস পুনর্বহালের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
অবসরপ্রাপ্ত এলডিসিদের আর্থিক সংকট শুধু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনেই প্রভাব ফেলছে না, বরং সমাজের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অনেকে ঋণ নিয়ে জীবনযাপন করছেন, যা তাঁদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। শ্যামল বলেন, “আমি আমার নাতি-নাতনির জন্য কিছু সঞ্চয় রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন নিজের খরচই চালাতে পারছি না।” অর্থনৈতিকভাবে, অবসরপ্রাপ্তদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে, যা অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলছে।
সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অষ্টম বেতন কমিশনের মাধ্যমে পেনশন বৃদ্ধি এবং ওপিএস পুনর্বহাল করা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, পেনশন সংস্কারে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- ন্যূনতম পেনশন বৃদ্ধি: ন্যূনতম পেনশন কমপক্ষে ২৫,০০০ টাকা করা উচিত, যাতে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায়।
- মহার্ঘ ভাতা সংশোধন: ত্রৈমাসিক বা অর্ধ-বার্ষিকভাবে মহার্ঘ ভাতা সংশোধন করা উচিত।
- চিকিৎসা সুবিধা: অবসরপ্রাপ্তদের জন্য বিনামূল্যে বা ভর্তুকিযুক্ত চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা।
- ওপিএস পুনর্বহাল: বাজার ঝুঁকি থেকে মুক্তি দিতে পুরাতন পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনা।
শ্যামল চক্রবর্তীর মতো অবসরপ্রাপ্ত এলডিসিদের গল্প আমাদের সামনে তুলে ধরে পেনশন সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন। অষ্টম বেতন কমিশন তাঁদের জন্য একটি আশার আলো, কিন্তু এর বাস্তবায়নে বিলম্ব তাঁদের দুঃখ বাড়াচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত এই সংস্কার বাস্তবায়ন করা, যাতে অবসরপ্রাপ্তরা তাঁদের জীবনের শেষ পর্যায়ে শান্তিতে বাঁচতে পারেন। শ্যামলের অপেক্ষা এবং আশা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন এর প্রবীণ নাগরিকরা সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন।