মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং G-7 দেশগুলোর মধ্যে সই হওয়া এক নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, মার্কিন-অধিভুক্ত কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক ট্যাক্স চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম থেকে ছাড় পাবে। কানাডা, যেটি বর্তমানে জি-৭ এর সভাপতির দায়িত্বে রয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন কোম্পানিগুলো “সাইড-বাই-সাইড” পদ্ধতির মাধ্যমে কেবল দেশীয় পর্যায়ে ট্যাক্স প্রদান করবে। অর্থাৎ, এরা দেশের ভিতরে এবং বিদেশের আয় উভয়ের উপরই কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর দেবে, অন্য কোনো দেশে নয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন অর্থমন্ত্রী বৈশ্বিক ট্যাক্স কাঠামোতে মার্কিন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি OECD/G20 অন্তর্ভুক্ত ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে গ্রহণ করা পিলার ২ নীতিমালার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি তুলে ধরেন। সেইসাথে তিনি একটি ‘সাইড-বাই-সাইড’ সমাধানের প্রস্তাব দেন, যেখানে মার্কিন-অধিভুক্ত কোম্পানিগুলো ইনকাম ইনক্লুশন রুল (IIR) এবং আন্ডারট্যাক্সড প্রফিটস রুল (UTPR) থেকে অব্যাহতি পাবে। কারণ, এরা ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যূনতম করের বিধান (minimum tax rules)-এর অধীনে রয়েছে।
জি-৭ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সাইড-বাই-সাইড সিস্টেমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ট্যাক্স ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা এবং নির্ভরযোগ্যতা আসবে। বিশেষ করে, ডিজিটাল অর্থনীতির কর ব্যবস্থা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা ও দেশগুলোর ট্যাক্স সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট এক্স (সাবেক টুইটার)-এ প্রকাশিত এক পোস্টে জানায়, সম্প্রতি মার্কিন সিনেটের “ওয়ান, বিগ, বিউটিফুল বিল” থেকে সেকশন ৮৯৯ বাতিলের ফলে এই সাইড-বাই-সাইড প্রস্তাবকে আরও এগিয়ে নেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। তারা জানিয়েছে, যোগ্য দেশীয় ন্যূনতম টপ-আপ ট্যাক্স (Qualified Domestic Minimum Top-up Tax) বাস্তবায়নের সাফল্য এবং এর প্রভাব পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “সেকশন ৮৯৯ বাতিলের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ট্যাক্স সিস্টেমে ইতিবাচক অগ্রগতি ধরে রাখা যাবে। বেস এরোশন এবং প্রফিট শিফটিং মোকাবিলায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর অর্জিত সাফল্য সংরক্ষিত হবে। পাশাপাশি, এই প্রস্তাব ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীলতা এবং আইনগত নিশ্চিততা প্রদান করবে।”
ব্রিটেনও এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা সেকশন ৮৯৯ এর কারণে সম্ভাব্য বাড়তি ট্যাক্সের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এই ধারা বাতিল হওয়ায় সেই আশঙ্কা কেটে গেছে।
জি-৭ এর অন্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা এমন একটি সমাধানের পক্ষে, যা সব অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য। তাঁরা জানান, “আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ আরও বাড়বে এবং ব্যবসায়িক পরিবেশে স্বচ্ছতা আসবে।”
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন প্রায় ১৪০টি দেশের সমর্থনে একটি বৈশ্বিক ন্যূনতম কর চুক্তি সম্পাদন করেছিল। সেই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল, আন্তর্জাতিক কর ফাঁকি এবং করের ভিত্তি ক্ষয় রোধ করা। কিন্তু, চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্রে এই বৈশ্বিক কর চুক্তি প্রযোজ্য হবে না।
এছাড়া ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, যারা দেশীয় কোম্পানির ওপর এই বৈশ্বিক কর নীতি কার্যকর করবে, তাদের ওপর প্রতিশোধমূলক ট্যাক্স আরোপ করা হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যরত অনেক বিদেশি কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন সাইড-বাই-সাইড প্রস্তাব কার্যকর হলে, যুক্তরাষ্ট্রে কোম্পানিগুলো নিজেদের ঘরোয়া ট্যাক্স কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ফলে, বিদেশি সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপের ঝুঁকি কমবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্কও মসৃণ থাকবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই প্রস্তাবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত নিজের কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে বৈশ্বিক কর ন্যায্যতা নষ্ট হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, এর ফলে অন্যান্য দেশগুলোর রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে এবং বৈশ্বিক ট্যাক্স সংস্কারের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তবুও জি-৭ দেশগুলো আশা করছে, এই সমাধানের মাধ্যমে সব দেশের ট্যাক্স সার্বভৌমত্ব এবং আয় সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এই চুক্তির বাস্তবায়ন কেমন হবে, তা এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কর প্রশাসনের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।