ভারত সরকার জৈব চাষকে (Organic Farming) উৎসাহিত করতে এবং কৃষকদের আর্থিকভাবে সুরক্ষিত করতে নতুন ভর্তুকি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পগুলি কৃষকদের জন্য শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জৈব চাষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং রাসায়নিক সারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ক্রেতাদের সচেতনতার কারণে, সরকার জৈব চাষের প্রসারে বিশেষ জোর দিয়েছে। এই নতুন প্রকল্পগুলি কৃষকদের জৈব সার, বায়ো-পেস্টিসাইড এবং অন্যান্য জৈব উপকরণ ব্যবহারে সহায়তা করবে, যা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
জৈব চাষের জন্য নতুন ভর্তুকি প্রকল্প
২০২৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জৈব চাষের জন্য একাধিক নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে পারম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (PKVY) এবং মিশন অর্গানিক ভ্যালু চেইন ডেভেলপমেন্ট ফর নর্থ ইস্ট রিজিয়ন (MOVCDNER)-এর উন্নত সংস্করণ উল্লেখযোগ্য। এই প্রকল্পগুলির অধীনে কৃষকরা প্রতি হেক্টরে ৩১,০০০ থেকে ৪৬,৫০০ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পাবেন তিন বছরের জন্য, যা জৈব সার, বায়ো-পেস্টিসাইড, বীজ এবং ভার্মিকম্পোস্টের মতো উপকরণ ক্রয়ে ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (FPO) গঠন, প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন এবং বিপণনের জন্যও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো ভারতীয় প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতি (BPKP), যা জিরো বাজেট ন্যাচারাল ফার্মিং (ZBNF)-এর নীতির উপর ভিত্তি করে। এই পদ্ধতি কৃষকদের রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় সম্পদের ব্যবহারে উৎসাহিত করে। এই প্রকল্পের অধীনে কৃষকরা শূন্য বাহ্যিক ইনপুট ব্যবহার করে জৈব চাষে প্রশিক্ষণ পাবেন এবং তাদের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য আর্থিক সহায়তা পাবেন। এছাড়া, জৈবিক কৃষি পোর্টাল ‘জৈবিক কৃষি’ কৃষকদের জৈব উৎপাদন বিক্রির জন্য একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে, যা কৃষকদের সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করে।
কৃষকদের জন্য আর্থিক সুবিধা
নতুন ভর্তুকি প্রকল্পগুলির মাধ্যমে কৃষকরা জৈব চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন জৈব সার, বায়ো-পেস্টিসাইড এবং ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন ইউনিট স্থাপনে সহায়তা পাবেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট সাবসিডি স্কিম (CISS)-এর অধীনে, বায়ো-ফার্টিলাইজার বা বায়ো-পেস্টিসাইড উৎপাদন ইউনিটের জন্য ২৫% ভর্তুকি দেওয়া হয়, যা প্রতি ইউনিটে সর্বোচ্চ ৪০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ফল ও সবজি বর্জ্য কম্পোস্ট ইউনিটের জন্য ৩৩% ভর্তুকি দেওয়া হয়, সর্বোচ্চ ৬০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এই ভর্তুকিগুলি কৃষকদের প্রাথমিক বিনিয়োগের বোঝা কমাবে এবং জৈব চাষের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়াবে।
এছাড়া, নতুন প্রকল্পগুলির মধ্যে কৃষি অবকাঠামো তহবিল (AIF) উল্লেখযোগ্য। এই তহবিলের মাধ্যমে কৃষকরা ফসল সংগ্রহের পরে অবকাঠামো যেমন কোল্ড স্টোরেজ, গুদাম এবং প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপনের জন্য ঋণ পেতে পারেন। এই সুবিধা জৈব উৎপাদনের মান বজায় রাখতে এবং বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য পেতে সহায়তা করবে।
পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর প্রভাব
জৈব চাষ শুধুমাত্র কৃষকদের জন্যই লাভজনক নয়, এটি পরিবেশের জন্যও উপকারী। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস পায়। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে জৈব চাষের অধীনে ১১.৮৩ লক্ষ হেক্টর জমি ছিল, যা ২০২০ সালে বেড়ে ২৯.১৭ লক্ষ হেক্টরে পৌঁছেছে। নতুন প্রকল্পগুলির লক্ষ্য ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ২০ লক্ষ হেক্টর জমি জৈব চাষের আওতায় আনা।
এই প্রকল্পগুলি অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। জৈব পণ্যের চাহিদা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমশ বাড়ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জৈব উৎপাদন রপ্তানির জন্য বিশেষভাবে ফোকাস করা হয়েছে, যেখানে ‘ওয়ান – অর্গানিক নর্থ ইস্ট’ ব্র্যান্ড চালু করা হয়েছে। এই ব্র্যান্ডের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য পাচ্ছেন, যা তাদের আয় বাড়াচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
জৈব চাষের প্রসারে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক কৃষক এখনও জৈব চাষের সুবিধা এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন নন। এছাড়া, জৈব পণ্যের বিপণন এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সচেতনতা প্রচারণা চালাচ্ছে। কৃষকদের জন্য স্থানীয় ভাষায় প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সরলীকরণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
আবেদন প্রক্রিয়া
কৃষকদের এই ভর্তুকি প্রকল্পের সুবিধা পেতে রাজ্য কৃষি বিভাগের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ এবং জমির নথিপত্রের মতো প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। এছাড়া, কৃষকদের ন্যূনতম ২০ হেক্টর জমির ক্লাস্টার গঠন করতে হবে এবং পার্টিসিপেটরি গ্যারান্টি সিস্টেম (PGS) সার্টিফিকেশনের জন্য আবেদন করতে হবে।
ভারত সরকারের নতুন ভর্তুকি প্রকল্পগুলি জৈব চাষের প্রসারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই প্রকল্পগুলি কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা এবং টেকসই কৃষির প্রচারে সহায়তা করবে। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলি ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব আনতে পারে। জৈব চাষের মাধ্যমে কৃষকরা শুধু তাদের আয়ই বাড়াতে পারবেন না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশও রেখে যেতে পারবেন।