রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (RIL)-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুকেশ আম্বানি (Mukesh Ambani ) তাঁর কোম্পানির ভবিষ্যত-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারত গড়ার কাজে রিলায়েন্সের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ম্যাককিন্সির গৌতম কুমরার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, “রিলায়েন্স শুধুমাত্র একটি কোম্পানি নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠান—একটি প্রক্রিয়া, যার লক্ষ্য দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।”
ধন নয়, দরকার প্রভাব:
মুকেশ আম্বানি তাঁর প্রয়াত পিতা ধীরুভাই আম্বানির দর্শনকে সামনে রেখে বলেন, “আমার বাবা বলতেন, যদি তুমি কেবল কোটিপতি হওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবসা শুরু করো, তবে তুমি নির্বোধ। কিন্তু যদি এক বিলিয়ন মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে চাও, তবে তোমার সাফল্যের সম্ভাবনা প্রকৃত অর্থেই বেশি।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই আজ রিলায়েন্সের ‘নর্থ স্টার’, অর্থাৎ পথপ্রদর্শক আদর্শ।
ধীরুভাই আম্বানি যিনি ইয়েমেনে একটি গ্যাস স্টেশনে কাজ করার সময় মাত্র $১০০ জমিয়ে রিলায়েন্স শুরু করেন, তখন হয়তো কেউ ভাবেনি এই কোম্পানি একদিন পেট্রোকেমিক্যাল, টেলিকম, খুচরা বাজার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির এক অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে।
“ভবিষ্যতের ব্যবসা” তৈরি করার সংকল্প:
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিটি বড় সিদ্ধান্ত একটি প্রশ্ন ঘিরেই আবর্তিত হয়—“ভারতের বিকাশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় কী, এবং আমরা কীভাবে তা দীর্ঘমেয়াদে ও বৃহৎ পরিসরে পূরণ করতে পারি?” ১৯৮০-র দশকে পলিয়েস্টার থেকে শুরু করে ২০১৬-তে জিও চালু করা এবং বর্তমানে সবুজ শক্তিতে বিপুল বিনিয়োগ—সব কিছুর মূলেই রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
জিও: ডিজিটাল ভারতের প্রথম ধাপ:
জিও চালু করতে রিলায়েন্স প্রায় $২৫ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছিল। তখন অনেকেই এই সাহসী পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু মুকেশ আম্বানি বলেন, “সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও যদি আমরা লাভ না করতাম, তবুও আমরা ভারতের ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে এক বিশাল দান করতাম। এটাই হতো ভারতের বৃহত্তম জনসেবামূলক কাজ।”
আজ, জিও শুধুমাত্র একটি টেলিকম সংস্থা নয়, এটি দেশের প্রতিটি প্রান্তে ডিজিটাল সংযুক্তি পৌঁছে দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে নতুন সুযোগ এনেছে।
রিলায়েন্স: একটি শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্য:
রিলায়েন্স এখন তার ৫০তম বর্ষপূর্তির দিকে এগোচ্ছে। মুকেশ আম্বানি বলেন, “আমার পিতার স্বপ্ন ছিল রিলায়েন্স এমন একটি প্রতিষ্ঠান হবে, যা আমাদের উভয়ের জীবনকালকেও অতিক্রম করবে। আমি সেই প্রতিশ্রুতিকে পালন করতে চাই—রিলায়েন্স ১০০ বছরও পার করবে।”
তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি ৪-৫ বছর অন্তর রিলায়েন্সের ব্যবসায়িক কাঠামো এবং দৃষ্টিভঙ্গি নতুন করে পর্যালোচনা করা হয়, যেন তা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
জাতি-প্রথম, ব্যবসা-পরে:
আম্বানি স্পষ্ট করে জানান, রিলায়েন্সের যাত্রা শুধুমাত্র ব্যবসা নয়—এটি এক ধরনের দেশসেবা। তাঁর মতে, “এই পৃথিবীতে কেউ কিছু নিয়ে আসে না, আর কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না। আপনি কেবল এমন কিছু রেখে যেতে পারেন যা মানুষের উপকারে আসে। সেই প্রতিষ্ঠানই হলো রিলায়েন্স।”
রিনিউএবল এনার্জি (পরিবেশবান্ধব শক্তি), আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে রিলায়েন্স আগামী দিনের ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে উঠতে চলেছে।
সবুজ শক্তির দিকে এগিয়ে চলা:
বর্তমানে রিলায়েন্স বৃহৎ পরিসরে গ্রিন এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করছে। তার মধ্যে রয়েছে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন, হাইড্রোজেন প্রযুক্তি এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের মতো উদ্যোগ। মুকেশ আম্বানির মতে, “শুধু লাভের কথা চিন্তা করলে ভবিষ্যত নির্মাণ সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের ব্যবসা মানে ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়ে তোলা।”
মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বে রিলায়েন্স আজ কেবলমাত্র একটি কর্পোরেট সংস্থা নয়, বরং একটি রূপান্তরকারী শক্তি হয়ে উঠেছে। এর প্রতিটি পদক্ষেপ ভারতকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সাহায্য করছে। ব্যবসা ও মানবিকতার সংমিশ্রণেই গড়ে উঠছে সেই প্রতিষ্ঠান, যার লক্ষ্য শুধুই লাভ নয়, বরং একটি নতুন ভারত নির্মাণ। রিলায়েন্সের এই যাত্রা একদিকে যেমন ধীরুভাই আম্বানির স্বপ্নের প্রতিফলন, অন্যদিকে তেমনই ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য এক শক্তিশালী ভিত্তি।