মিলন পণ্ডা, কাঁথি: আবাস যোজনা বাড়ি পেতে হলে তৃণমূল (TMC) কাউন্সিলরকে দিতে হবে মোটা অঙ্কের কাটমনি। শুধু কাটমানি দিলে হবে না, তারপরেও নিজের লোক হতে হবে। এমনটা অভিযোগ উঠেছে৷ ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে৷
আবাস যোজনা বাড়ি তৈরি করার জন্য তৃণমূলের কাউন্সিলর’কে এক লক্ষ টাকা দিয়েও, মাঝপথে আটকে গেল বাড়ি। আবারও আবাসের ঘর পেতে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তৃণমূলের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি পুরসভার ১ নং ওয়ার্ডে ঘটনা। এই ওয়ার্ডে বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। কোনওমতে দুবেলা অন্ন জোগাড় হয়।
এই পরিস্থিতিতে মাথার ওপর পাকা ছাদের ব্যবস্থা করতে তাঁরা অপারক। তাই আবেদন করেছিলেন সরকারি আবাসের যোজনা বাড়ির জন্য। সেখানেও কাটমানি! অভিযোগ, বাড়ি পাইয়ে দেওয়ার নামে টাকা নিয়েছেন তৃণমূলের কাউন্সিলর শেখ সাবুল। কিন্তু তারপরও ঘর অর্ধনির্মিত।
অভিযোগ, ১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসে অন্য গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত খেতে যাওয়াই হয়েছে কাল। গোঁসা হয়েছে তৃণমূলের কাউন্সিলর শেক সাবুলের। আটকে দেওয়া হয়েছে আবাসের টাকা বলেই অভিযোগ। ঋণ নিয়ে ঘর করেছেন ধার কীভাবে পরিশোধ সেই চিন্তায় ঘুম উড়েছে অভিযোগকারীদের। দেনার দায়ে আত্মহত্যা পরিস্থিতি হয়েছে বলেও জানালেন এক ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে কাটামানি নেওয়া আরও বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন ওয়ার্ডে এক ভিক্ষুক মহিলাও। অভিযোগ আবাসের ঘর পাইয়ে দিতে গুনে গুনে ৫ হাজার টাকা নিয়েছে কাউন্সিলর। ফলে অর্ধনির্মিত ঘর নিয়ে দোলাচলে ওই মহিলাও। কাউন্সিলারে এমন কর্মকাণ্ডে হাতিয়ার করে মাঠে নেমে পড়েছি রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। তৃণমূলকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি এককি ভাবে সিপিএম ও বিজেপি। যদিও তৃণমূলের কাউন্সিলর এই সমস্ত অভিযোগ উড়িয়েছেন। তাঁর দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কাঁথি পুরসভা ১ নং ওর্য়াড়ে তৃণমূল কাউন্সিলর হলেন শেখ সাবুল। পরপর দু’বার এই ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন। ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক লক্ষ টাকা সুদ নিয়ে, এখন সুদের পরিবার দাঁড়িয়েছে ৫ লক্ষ টাকা। পরবর্তী দিনে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে।
তৃণমূল এই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে কাটমানি অভিযোগ উঠায় অস্বস্তিতে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী জেলায় খোদ কাঁথিতে তৃণমূল কাটমানি নেওয়ার অভিযোগে রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়েছে।
চায়ের দোকান থেকে পানের দোকানে কান পাতলেও তৃণমূল নেতার আবাস যোজনার বাড়ি দেওয়া নামে কাটমানির কথা চর্চা শোনা যায়। অপর এক বাড়ির প্রাপক আকবর আলি খান বলেন, “বাড়ির জন্য ২৫ হাজার কাটমানি হিসেবে ১০০০০ টাকা অতিরিক্ত নিয়েছেন কাউন্সিলর শেখ সাবুল। এখন বলছে বাড়ির টাকা দেবো না। আমি সূদে টাক ধার করে বাড়ি তৈরি করেছি৷”
বাড়ি না পেয়ে কার্যত কাউন্সিলর দিকে ক্ষোভ উগড়ে দেন। ওয়ার্ড়ে বাসিন্দা শেক ঝড়ু বলেন, “ভগ্ন বাড়ি থাকার পরও বাড়ি পায়নি। ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কে কাটমানি টাকা দিতে পারিনি বলে বাড়ি পায়নি। সরকারি প্রকল্পের তালিকায় যখন আমার নাম এলে, তখন কাউন্সিলরের জানায় তুমি আমার লোক নয় তাই এক লক্ষ টাকা দিতে হবে৷”
ওয়ার্ডে ভিক্ষুক মহিলার কাছ থেকেও বাড়ির জন্য ৫ হাজার টাকা কাটমানি নিয়েছেন কাউন্সিলর। বাসিন্দা জানু বেগম বলেন, “ভিক্ষা করে কোন রকমে দিন কাটান এই বয়স্ক মহিলা। আবাস যোজনার ১ লক্ষ্য ৪৫ হাজার টাকা পেয়ে, বাড়ি শুরু করেছেন, দুবছর আগে। তারপর আর টাকা পাচ্ছেন না। ফলে বাড়ি তৈরিও মাঝপথে বন্ধ। ঝড় বৃষ্টির দিনে বাড়ি বাঁচাতে একমাত্র সহায় ত্রিপল৷”
ওয়ার্ড়ে বাসিন্দা শেখ আনোয়ার আলি বলেন, “আমাকে ১ লক্ষ টাকা দিতে হবে, তাহলে তোকে বাড়ি দেব। আমি মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা এনে এক লক্ষ টাকা কাউন্সিলের হাতে দেই। আমি প্রত্যেকদিন ৬০০ টাকা করে সুদ দিচ্ছি। পরবর্তী পর্যায়ে ৪৫ হাজার টাকা ঢোকে। সবার পরবর্তী কালে ১ লাখ টাকা ঢুকলেও, আমি সেই টাকা পায়নি৷”
যদিও ওয়ার্ড বাসিন্দাদের এই সমন্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাঁথি পুরসভা ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সেক সাবুল। তিনি বলেন, “২০১৫ সাল থেকে কাউন্সিলর হয়ে আছি। এখন যাদের বাড়ি দরকার তাদের বাড়ি দিয়েছি। যারা অভিযোগ করেছেন, কি জন্য করছেন তা বলতে পারবো না। এই রকম কাজের জন্য সঙ্গে য়ুক্ত নই। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন কর্মকাণ্ড করছেন৷ এরা আগে আমাদের সঙ্গে ছিল, কাজ করে দেওয়া নাম টাকা নিয়েছে। ঘটনা জানতে পেরে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই, তারপরেই এমন করেছে৷”
অভিযোগ খতিয়ে দেখায় আশ্বাস দিয়েছেন কাঁথি পুরসভা পুরপ্রধান সুপ্রকাশ গিরি। তিনি বলেন, ” আবাশ যোজনা দীর্ঘদিন প্রকল্প চলছে। কাঁথি শহরবাসী আবোদন জানিয়েছিলাম, কোন প্রবোচনা দেবেন না। সরকারি নিয়ম মাফিক বাড়ি করেনি প্রশ্ন নেই। যে টাকা নিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। যা দিচ্ছেন তারও দেবেন কোন? সঠিকভাবে বাড়ি প্রাপক হয়ে থাকেন, তাহলে কাউকে ধরার প্রয়োজন নেই। সঠিক অভিযোগ আসে তাহলে খতিয়ে দেখা হবে। ঘটনাটি সঠিক হয়, প্রয়োজনীন পদক্ষোপ দেওয়া হবে। কেউ টাকা চায় তাহলে সরাসরি পুরসভা এসে যোগযোগ করুন৷”
তৃণমূল নেতা এই কর্মকাণ্ডের তীব্র কটাক্ষ করেছে সিপিএম ও বিজেপি। কাঁথি সংগঠনিক জেলার বিজেপি সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রশেখর মণ্ডল বলেন, “দলটা তৃণমূল। কাউন্সিলর তৃণমূলের, চুরিটা তাদের পেশা ও নেশা। খোঁজখবর নিয়ে দেখুন, এরা রাজ্য তৃণমূলের নেতৃত্বের কাছে চুরির ভাগ পৌঁছে দিচ্ছে৷”
অন্যদিকে, এলাকায় অভিয়োগ সত্যতা আছে দাবি করেছেন। সিপিএম নেতা ঝাড়েশ্বর বেরা বলেন, “এলাকাবাসী যে অভিযোগ করছে, আমরা দীর্ঘদিন ধরে পুরসভা কাউন্সিলর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছি, শুধু আবাশ যোজনা বাড়ি ক্ষেত্রে কাটমানি তা নয়, রাস্তাঘাট থেকে জল নিকাশি ক্ষেত্রে তোলাবাজি ও দুর্ণীতি নাম তৃণমূল। এইজন্য কাউন্সিলর হয়েছেন। তৃণমূলের নামেই তোলাবাজি তার প্রমাণ৷”