তেহরান: মধ্যপ্রাচ্যের দুই চিরবৈরী শক্তি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন করে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। শনিবার ভোররাতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট আঘাত হানে ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে। একই সময় বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে জেরুজালেম। পাল্টা প্রতিশোধে ইসরায়েলও একাধিকবার বিমান হামলা চালায় ইরানের রাজধানী তেহরানে। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল ও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’
একদিন আগেই ইসরায়েল শুরু করেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান – ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরান চালায় ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস’। দুই দেশের মধ্যে এই পাল্টাপাল্টি হামলা এখন বহু প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরানের হামলায় তেল আবিবে একজন নিহত হন এবং প্রায় ৩৪ জন আহত হন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগ। একই সময়ে, ইসরায়েলও পাল্টা আক্রমণ চালায় ইরানের রাজধানী তেহরানে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, মেহরাবাদ বিমানবন্দরের কাছে একাধিক বিস্ফোরণ হয়েছে। বিমানবন্দরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ইরানি ফাইটার জেট এবং সামরিক পরিবহন বিমান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওই স্থানে আগুন লাগারও খবর মিলেছে।
নিশানায় ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প Iran Israel Conflict
ইসরায়েলের দাবি, তাদের অভিযানের মূল লক্ষ্য ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে ধ্বংস করা। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে জানান, “এটা অভিযানের শুরু মাত্র। আমাদের লক্ষ্য ইরানের সেই পরমাণু কর্মসূচিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ইরানের নিপীড়নকারী ইসলামিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, যারা নিজেদের জনগণকে দারিদ্র্য ও নির্যাতনের মধ্যে রেখেছে।”
অন্যদিকে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন, “ইসরায়েল তাদের কৃতকর্মের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ভোগ করবে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনী এই শত্রুকে জবাব দেবে।” এই ভাষণের কিছুক্ষণ পরেই ইরান হামলা চালায় তেল আবিবে।
পরমাণু চুক্তি
এই সংঘর্ষ এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন আমেরিকা ইরানকে নতুন একটি পরমাণু চুক্তির আওতায় আনতে চাপ দিচ্ছিল। তবে ইসরায়েলের এই আকস্মিক সামরিক অভিযান সেই আলোচনার ভিত্তিই নড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, “আপনি যদি একদিকে শান্তির কথা বলেন, আবার অন্যদিকে ইসরায়েলের মাধ্যমে আমাদের মাটিতে আক্রমণ চালান, তাহলে সেই আলোচনার আর কোনও অর্থ থাকে না।”
অন্যদিকে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “আমরা সব জানতাম। আমি চেয়েছিলাম ইরানকে এই বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে। এখনও চুক্তির রাস্তা খোলা আছে, তবে ইরান যদি এখন চুক্তি না করে, তাহলে আরও ভয়ানক হামলার মুখোমুখি হতে পারে।”
তিন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা নিহত
শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের তিন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা নিহত হন – সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মহম্মদ বাঘেরি, রেভলিউশনারি গার্ডের প্রধান জেনারেল হোসেইন সালামি এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রামের প্রধান জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ। বিশ্লেষকদের মতে, এত উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের মৃত্যুর পর ইরান নরম থাকবে, সেই সম্ভাবনা নেই।
এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় পক্ষকে অবিলম্বে আক্রমণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান খুঁজতে বলেছেন। তবে ইসরায়েলের রাষ্ট্রপুঞ্জে নিযুক্ত দূত জানিয়েছেন, “আমরা ইরানে যতক্ষণ না সব হুমকি নির্মূল করছি, ততক্ষণ অভিযান বন্ধ করব না।”
মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা নেতানিয়াহুর
এদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। নেতানিয়াহু তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “আমরা এই সংঘর্ষে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখছি। উভয় পক্ষকে সংযত থাকতে ও উত্তেজনা না বাড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।”
বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই যুদ্ধ যদি দ্রুত থামানো না যায়, তবে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরেও বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে।