ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি (SEBI) শুক্রবার এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তায় দেশের বিভিন্ন সংস্থার চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসারদের (CFO) প্রতি আহ্বান জানায়, যাতে তারা বার্ষিক আর্থিক ফলাফল প্রকাশ এবং সম্পূর্ণ বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমান। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে বলে মনে করছে সেবি।
বর্তমানে বার্ষিক ফলাফল ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ বার্ষিক প্রতিবেদন (Annual Report) প্রকাশে ৭০ থেকে ১৪০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। সেবির হোল টাইম মেম্বার (WTM) অনন্ত নারায়ণ এ তথ্য জানান ETCFO NextGen 2025 ইভেন্টে।
তিনি বলেন, “সম্পূর্ণ বার্ষিক প্রতিবেদন—যেখানে নোট টু অ্যাকাউন্টস, ইন্টারনাল কন্ট্রোল রিপোর্ট, অডিট কী ম্যাটারস এবং CARO (Companies Auditor’s Report Order) অন্তর্ভুক্ত থাকে—তা অনেক বেশি তথ্যবহুল। এই সময় কমিয়ে আনলে বিনিয়োগকারীরা সংস্থার স্বচ্ছতা সম্পর্কে দ্রুত ধারণা পাবেন।”
CFO-দের দায়িত্ব আরও ব্যাপক
অনন্ত নারায়ণ বলেন, আজকের CFO শুধুমাত্র হিসাবরক্ষক নন, বরং একজন “ভ্যালু আর্কিটেক্ট” বা মূল্য সৃষ্টির স্থপতি। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ভবিষ্যতদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্যকে নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করা।
“আপনি যখন আর্থিক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, সেটা কেবল একটি প্রথাগত কাজ নয়। বরং এটি একটি প্রতিশ্রুতি—যে সংস্থার আর্থিক অবস্থা প্রকৃত ও নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রতিশ্রুতির ওপরেই বাজারের আস্থা গড়ে ওঠে। যদি সেই আস্থা ভেঙে যায়, তার প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।”
অডিট কমিটি ও নিরীক্ষকদের সঙ্গে অধিকতর সহযোগিতা
সেবি CFO-দের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন অডিট কমিটি ও নিরীক্ষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, যাতে সারা বছরের নিরীক্ষা পরিকল্পনা (Audit Plan) যৌথভাবে গঠিত হয়। নিরীক্ষকরা যেন কেবলমাত্র নির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে না এসে, বরং পূর্ণাঙ্গভাবে অডিট কমিটির অংশ হন—এমনটাই পরামর্শ দেন অনন্ত নারায়ণ।
তিনি বলেন, এতে বোর্ড, নিরীক্ষক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিশ্বাস ও যোগাযোগ বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে সবার উপকারে আসবে।
SEBI , SEBI Guidelines, CFO Role, Financial Results Delay, Annual Report Transparency অনন্ত নারায়ণ ভারতের সিকিউরিটিজ মার্কেটের দ্রুত বৃদ্ধির কথাও তুলে ধরেন। ২০২০ সালের মার্চে যেখানে ইউনিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৪.২ কোটিতে, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৩ কোটি। শুধুমাত্র মিউচুয়াল ফান্ডেই ৬ কোটি ইউনিক বিনিয়োগকারী রয়েছে, যা ছয় বছর আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে মিউচুয়াল ফান্ডগুলিতে রেকর্ড ৬ লক্ষ কোটি টাকা ইক্যুইটি ও রিস্ক-সিকিং ফান্ডে সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া মে ২০২৫ পর্যন্ত FPI (Foreign Portfolio Investors) বিনিয়োগকারীরা ভারতে ৭১ লক্ষ কোটি টাকার ইক্যুইটি হোল্ডিং করেছেন।
ভুলের ধরন: টাইপ I ও টাইপ II
নারায়ণ বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে হলে দুটি ভুল এড়াতে হবে
টাইপ I ত্রুটি: যেমন—প্রশাসনিক ব্যর্থতা, প্রযুক্তিগত বিপর্যয়, প্রতারণা, তথ্য গোপন করে লেনদেন ইত্যাদি। এগুলোর ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টাইপ II ত্রুটি: অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মের ফলে নতুন উদ্যোগ ও উদ্ভাবনী শক্তি বাধাগ্রস্ত হওয়া। যেহেতু AI, অটোমেশন ও এনার্জি-নির্ভর প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, তাই এসব বাধা উন্নয়নে অন্তরায় হতে পারে।
আস্থা ভঙ্গের উদাহরণ
নারায়ণ কিছু বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরেন, যেখানে তালিকাভুক্ত সংস্থা থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া, হিসাব ও সম্পদ মূল্যায়নে বিভ্রান্তিকর কৌশল প্রয়োগ, এবং অপ্রকাশিত তথ্য ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ লেনদেনের মতো ঘটনাগুলি ঘটে। এসব ঘটনাকে টাইপ I ত্রুটির অন্তর্গত হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ
নারায়ণ বলেন, বর্তমানে কিছু সংস্থার মধ্যে “Valuation Shopping”-এর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—যেখানে সংস্থাগুলি তাদের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক মূল্যায়নের সন্ধান করে। তিনি বলেন, যেমনভাবে Credit Rating Agencies তাদের পূর্বতন রেটিং প্রকাশ করে, তেমনভাবেই এখন সময় এসেছে যে মূল্যায়ন সংস্থারাও তাদের অনুমান, সংবেদনশীলতার পরিসর, এবং পূর্ববর্তী রেকর্ড প্রকাশ করুক ও অনিয়মের জন্য দায়বদ্ধ হোক।
CFO-দের সেবির নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান
সেবির WTM বলেন, সেবি যেভাবে পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া যেমন—অ্যাডভাইজরি কমিটি, পাবলিক কনসালটেশন ও রেগুলেটরি ওয়ার্কিং গ্রুপের মাধ্যমে নিয়ম প্রণয়ন করে, সেখানে CFO-দের সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত। তিনি CFO-দের উদ্দেশে বলেন, “সম্ভবত এখন সময় এসেছে, আপনারাও সংগঠিত হয়ে নীতিনির্ধারণে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।”
অনন্ত নারায়ণের বক্তব্যে CFO-দের প্রতি বার্তাটি পরিষ্কার—আর্থিক স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ববোধ যেন শুধুমাত্র নিয়ম মানা না হয়ে, সেটি হয়ে ওঠে আস্থা রক্ষার অভিমুখ। তাহলেই টেকসই পুঁজিবাজার গড়ে উঠবে, যেখানে সব পক্ষের উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।