মে মাসে ভারতের শেয়ারবাজারে বিপুল পরিমাণে পুঁজি ঢালার পর, জুনের প্রথম সপ্তাহেই হঠাৎ করেই বিপরীত পথে হাঁটলেন বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা (FPIs)। তারা মোট ৮,৭৪৯ কোটি টাকার বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন ভারতীয় ইকুইটি মার্কেট থেকে। এই আকস্মিক মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে মূলত দুটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে — যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনার পুনর্জাগরণ এবং আমেরিকার বন্ড ইল্ডে লাফ।
ডিপোজিটরি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে যেখানে FPIs মোট ১৯,৮৬০ কোটি টাকা ঢালেন, তার আগের মাস এপ্রিলেও ৪,২২৩ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ এসেছিল। অথচ জুনের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে একেবারে বিপরীত ছবি। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত FPIs মোট ১.০১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ভারতীয় ইকুইটি বিক্রি করে ফেলেছেন। জানুয়ারিতে তারা ৭৮,০২৭ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৪,৫৭৪ কোটি এবং মার্চে ৩,৯৭৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন।
আন্তর্জাতিক অস্থিরতা ও বন্ড ইল্ডে ঊর্ধ্বগতি বিনিয়োগে চাপ সৃষ্টি করেছে
মর্নিংস্টার ইনভেস্টমেন্টের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর হিমাংশু শ্রীবাস্তব জানান, “বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হয়েছে, তার মূল কারণ আমেরিকা ও চীনের মধ্যে আবারও বাণিজ্য উত্তেজনার সৃষ্টি এবং আমেরিকার বন্ড ইল্ডে দ্রুত বৃদ্ধি। ফলে বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকেছেন।”
তিনি আরও জানান, “এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন তদন্ত — যেখানে ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এই খবরও বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং প্রধান সূচকগুলিকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।”
রিজার্ভ ব্যাংকের নীতিগত চমক কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে
যদিও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করেছে, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিগত সিদ্ধান্ত কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI) হঠাৎ করে রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট এবং ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (CRR) ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে দিয়েছে, যা বাজারে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।
Geojit Investments-এর চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট ভি কে বিজয়কুমার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা যেখানে দুর্বল, সেখানে ভারত এখন একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, FY26-এ ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম। তবে উদ্বেগের বিষয় হল, শেয়ারের উচ্চ মূল্যায়ন, যা বাজারে নতুন ঊর্ধ্বগতি চালিয়ে যাওয়ার জায়গা কমিয়ে দিয়েছে।”
ঋণ বাজারেও ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ প্রত্যাহার
শুধু ইকুইটি সেগমেন্টেই নয়, ঋণ বাজারেও একই চিত্র। জুন ২ থেকে ৬-এর মধ্যে FPIs মোট ৬,৭০৯ কোটি টাকা তুলেছেন ডেট জেনারেল লিমিট থেকে এবং ৫,৯৭৪ কোটি টাকা ডেট ভলান্টারি রিটেনশন রুট (VRR) থেকে।
বিজয়কুমার বলেন, “FPIs ঋণ বাজারে কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করছেন। এর প্রধান কারণ, মার্কিন ও ভারতীয় বন্ডের মধ্যে রিটার্নের পার্থক্য এখন অনেক কম, ফলে অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়ার আগ্রহ নেই।”
সাম্প্রতিক এফপিআই প্রত্যাহার ভারতের পুঁজিবাজারের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্কেত। আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তা, বন্ড ইল্ডে চাপ, এবং দেশীয় কর্পোরেট বিতর্ক মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন আরও সতর্ক। তবে রিজার্ভ ব্যাংকের উদার নীতি ও ভারতের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা আগামী দিনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সহায়ক হতে পারে। তবে শেয়ারের অতিমূল্যায়ন ও বৈশ্বিক অস্থিরতা এই পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের উচিত বাজারের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পোর্টফোলিও সাজানো। যাঁরা নতুন করে বাজারে প্রবেশ করতে চাইছেন, তাঁদের জন্য কিছুটা ধৈর্য ও গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজন।