দেশে ভোজ্যতেলের (Edible Oil) দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং দেশীয় রিফাইনিং শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরিশোধিত পাম অয়েল, সয়াবিন অয়েল এবং সূর্যমুখী তেলের উপর প্রযোজ্য মূল কাস্টমস ডিউটি বা শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের তরফে শুক্রবার জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়, যা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে উপরের তিনটি অপরিশোধিত তেলে মোট কার্যকর আমদানি শুল্ক ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমে ১৬.৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা সেস ও সারচার্জসহ হিসাব করা হয়েছে। তবে পরিশোধিত তেলে শুল্ক অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে — এখনো পর্যন্ত পরিশোধিত ভোজ্যতেলে মূল কাস্টমস ডিউটি ৩২.৫ শতাংশ এবং কার্যকর শুল্ক ৩৫.৭৫ শতাংশই রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন খুচরো স্তরে ভোজ্যতেলের মূল্য কমাতে সাহায্য করবে, তেমনি দেশীয় তেল পরিশোধন শিল্প ও কৃষকদের লাভবান করবে।
কেন এই পদক্ষেপ?
ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভোজ্যতেল আমদানিকারক দেশ। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে (নভেম্বর–অক্টোবর) ভারত ১৫৯.৬ লক্ষ টন ভোজ্যতেল আমদানি করেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের মোট ভোজ্যতেল চাহিদার ৫০ শতাংশেরও বেশি আমদানির উপর নির্ভরশীল। পাম অয়েল আমদানি হয় মূলত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে, এবং সয়াবিন অয়েল আসে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে।
তবে সম্প্রতি দেখা গেছে, SAFTA (South Asian Free Trade Area) চুক্তির অধীনে শূন্য শুল্কে পরিশোধিত পাম অয়েলের আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যার ফলে দেশীয় রিফাইনারিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই কারণেই ইন্ডিয়ান ভেজিটেবল অয়েল প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (IVPA) এবং সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (SEA) দীর্ঘদিন ধরে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের মধ্যে শুল্ক ব্যবধান বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিল।
শুল্ক ব্যবধান বাড়িয়ে দেশের শিল্পকে রক্ষা
এই নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এখন অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের মধ্যে শুল্ক ব্যবধান ৮.২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯.২৫ শতাংশে। SEA-এর সভাপতি সঞ্জীব আস্থানা বলেন, “এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। এটি পরিশোধিত তেলের আমদানি নিরুৎসাহিত করবে এবং অপরিশোধিত পাম অয়েলের চাহিদা বাড়িয়ে দেবে, যার ফলে দেশীয় পরিশোধন শিল্প নতুন গতি পাবে।”
SEA-এর নির্বাহী পরিচালক বি ভি মেহতা বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের রিফাইনারিগুলিকে অনেকটা স্বস্তি দেবে এবং স্থানীয় কৃষকরাও এতে উপকৃত হবেন।”
অপরদিকে, IVPA-র সভাপতি সুধাকর দেশাই জানান, “আমাদের সুপারিশ মেনে সরকার যেভাবে শুল্ক ব্যবধান ১৯.২৫ শতাংশে উন্নীত করেছে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। এটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির বাস্তবায়নের একটি বড় পদক্ষেপ। দেশের ভোজ্যতেল খাতের সক্ষমতা রক্ষা করতে ও বৈষম্যমূলক বাণিজ্য বন্ধ করতে এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
SAFTA-র অধীনে বিপুল পরিমাণে পরিশোধিত তেল আমদানি
IVPA-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন-সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেখানে পরিশোধিত পাম অয়েলের আমদানি ছিল ৪.৫৮ লক্ষ মেট্রিক টন, সেখানে ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.২৪ লক্ষ মেট্রিক টনে — যা মোট পাম অয়েল আমদানির প্রায় ৩০ শতাংশ। শূন্য শুল্কের সুবিধার কারণে এই পরিমাণ আমদানি দেশীয় শিল্পের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে।
উপকারভোগী কারা?
এই সিদ্ধান্তের ফলে তেল পরিশোধন শিল্প যেমন উপকৃত হবে, তেমনই সরাসরি লাভবান হবেন দেশের সাধারণ ভোক্তারা। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে খুচরো বাজারে প্যাকেটজাত ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমতে পারে।
এছাড়া, অপরিশোধিত তেলের আমদানি বাড়লে দেশীয় রিফাইনারিগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা আরও বেশি করে ব্যবহৃত হবে এবং স্থানীয় কৃষকরাও তেলের বীজ বিক্রির ক্ষেত্রে ন্যায্য মূল্য পাবেন।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত যে শুধু বাজারে মূল্য স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে তা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দেশের কৃষক, শিল্পপতি ও ভোক্তাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে একটি আত্মনির্ভর ভোজ্যতেল খাত গড়ে তুলবে বলেই আশা করা হচ্ছে। Make in India নীতিকে সফল করতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতেও আরও নেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল।