ভারতের নতুন আমদানি বিধিনিষেধে বড় বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের একাধিক রপ্তানিকারক সংস্থা, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ (PRAN Group)। সম্প্রতি ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রকের ঘোষণায় জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট পণ্য আর ঢুকতে পারবে না ভারতের বাজারে। এর মধ্যে রয়েছে রেডিমেড পোশাক, ফল, ফলের স্বাদের পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, তুলো, সুতো, প্লাস্টিক পণ্য এবং কাঠের আসবাবপত্র।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রপ্তানি একটি বড় স্তম্ভ, বিশেষত তৈরি পোশাক খাত। প্রতিবছর শত কোটি টাকার রপ্তানি হয় ভারতসহ অন্যান্য দেশে। ভারতে তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার থাকলেও এবার সেই রপ্তানিতে বড় কোপ এসেছে। স্থলপথে এসব পণ্য আর ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না, তবে জলপথে—কলকাতা বা মুম্বই বন্দরের মাধ্যমে—এইসব পণ্য ঢুকতে পারবে। কিন্তু জলপথে পরিবহন ব্যয়বহুল হওয়ায় ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে।
এই বিধিনিষেধ সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ আরএফএল-কে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফল এবং ড্রিঙ্কের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে প্রাণের পণ্য। কলকাতার বিভিন্ন টেলিভিশন শোতেও প্রাণের স্পনসরশিপ লক্ষ করা গেছে। ভারতে এই কোম্পানির বার্ষিক রপ্তানি প্রায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার। ফলে এমন সিদ্ধান্তে সংস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।
প্রাণ আরএফএল-র পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানিয়েছেন, “ভারতে আমাদের প্রায় প্রতিটি পণ্য শ্রেণিতেই প্রভাব পড়ছে। এটি শুধু আমাদের কোম্পানির জন্য নয়, বরং দেশের জন্যও একটি বড় হুমকি।” সীমান্তে প্রাণের বহু পণ্য বোঝাই ট্রাক আটকে পড়েছে বা ফেরত পাঠানো হয়েছে, যা সরবরাহ শৃঙ্খলেই ভাঙন ধরিয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনা সরকার ২০২৪ সালের শেষভাগে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় এবং তিনি বর্তমানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ভারতে অবস্থান করছেন। ভারতের নয়া পদক্ষেপকে অনেকেই রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রকের এক কর্মকর্তার দাবি, এটি “পারস্পরিক পদক্ষেপ” (reciprocal measure)। কারণ গত মাসেই বাংলাদেশ ভারত থেকে সুতো ও চাল আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল একই স্থলবন্দর দিয়ে। ভারতীয় পক্ষের মতে, এই পদক্ষেপ দুই দেশের জন্যই “সমান বাজার প্রবেশাধিকার” ফিরিয়ে আনবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, “এই সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে টেক্সটাইল শিল্পে প্রভাব ফেলবে ঠিকই, তবে আমাদের রপ্তানিকারকরা বিকল্প রাস্তায় সমাধান খুঁজে নেবেন।” অন্যদিকে, নিটওয়্যার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এই টিট ফর ট্যাট পদক্ষেপ সীমান্ত বাণিজ্যে বড় ধাক্কা দেবে।”
এপ্রিলে ভারত ২০২০ সালের একটি ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তিও বাতিল করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় জমি হয়ে তৃতীয় দেশে রপ্তানি করতে পারত। এই সিদ্ধান্তগুলোর ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বড় বাধা তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এই বাণিজ্য সংকটের পেছনে মূল চালিকাশক্তি। যদি দ্রুত কোনও কূটনৈতিক সমাধান না আসে, তবে বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতিতে বড় আঘাত আসবে, বিশেষ করে এমন সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে যারা ভারতে নির্ভরশীল। এখন সময় দুই দেশের নেতৃত্বের—এই সংকটের শান্তিপূর্ণ ও লাভজনক সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।