Gold vs Mutual Funds: বাজার যখন অস্থির হয়ে ওঠে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ দেখা দেয়। এই সময়ে তাঁদের বিনিয়োগের বিশ্বাস ও কৌশল প্রশ্নের মুখে পড়ে। অস্থিরতার এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যেমন সোনা, নগদ অর্থ বা সরকারি সিকিউরিটিজ। এই সম্পদগুলোকে সাধারণত স্থিতিশীল ও নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, এই স্বল্পমেয়াদি নিরাপত্তা কি দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্য পূরণে সহায়ক? আসুন, বাজারের অস্থিরতার সময় সোনা এবং ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের আচরণ বিশ্লেষণ করে দেখি এবং বুঝি এটি আপনার সম্পদ সৃষ্টির যাত্রায় কী প্রভাব ফেলে।
সোনা: নিরাপদ সম্পদের আশ্রয়
সোনা দীর্ঘদিন ধরে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ সম্পদ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক সংকটের সময় সোনার দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারী, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের বৈশ্বিক শুল্ক আরোপের মতো ঘটনাগুলোতে সোনার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল বিনিয়োগের উত্থান, যেমন গোল্ড ইটিএফ (এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং সার্বভৌম স্বর্ণ বন্ড (এসজিবি), বিনিয়োগকারীদের জন্য এই সম্পদে বিনিয়োগ করা আরও সহজ করেছে।
ফিনএজ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিওও ময়ঙ্ক ভাটনাগর বলেন, “সোনার দীর্ঘমেয়াদি রিটার্নের সম্ভাবনা সীমিত। এটি মূলত অস্থির সময়ে বাজারের ঝুঁকি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।” তিনি আরও জানান, “ইক্যুইটির বিপরীতে সোনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অংশ নেয় না। এর পারফরম্যান্স মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, যখন ভয় বা অনিশ্চয়তা বাড়ে তখন এর দাম বাড়ে এবং বাজারে আশাবাদ ফিরে এলে তা স্থিতিশীল হয়। তাই সোনা একটি কৌশলগত সম্পদ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির জন্য এটি সর্বোত্তম নয়।” সোনা একটি বৈচিত্র্যময় পোর্টফোলিওতে হেজ হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতির সময় বা বৈশ্বিক অস্থিরতার মুহূর্তে।
ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড: দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টি
অন্যদিকে, ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড স্বল্পমেয়াদে অস্থির হলেও দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ভাটনাগর বলেন, “বাজারের অস্থিরতার সময় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেওয়া স্বাভাবিক, এবং অনেকে ইক্যুইটি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত প্রায়শই সুযোগ হারানোর কারণ হয়। অস্থিরতা হল দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রিটার্নের জন্য যে মূল্য দিতে হয়।”
ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড লক্ষ্যভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। কোম্পানি এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে অংশ নিয়ে এই ফান্ডগুলো বিনিয়োগকারীদের সময়ের সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি লাভের সুযোগ দেয়। সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (এসআইপি) এবং সিস্টেম্যাটিক ট্রান্সফার প্ল্যান (এসটিপি)-এর মতো কৌশলগুলো অস্থিরতাকে সুবিধায় রূপান্তরিত করে। এই কৌশলগুলো বিনিয়োগকারীদের কম দামে বেশি ইউনিট কেনার সুযোগ দেয়, যা গড় ক্রয় মূল্য কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদি লাভের সম্ভাবনা বাড়ায়। ভাটনাগর বলেন, “বাজারের চক্রের মধ্য দিয়ে ধৈর্য ধরে বিনিয়োগ করা ঐতিহাসিকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ বিনিয়োগকারীদের পুরস্কৃত করেছে।”
সোনা বনাম মিউচুয়াল ফান্ড: তুলনা
২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সোনার গড় বার্ষিক রিটার্ন ছিল প্রায় ৮-১০%, যেখানে ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড, বিশেষ করে লার্জ-ক্যাপ এবং মিড-ক্যাপ ফান্ড, ১২-১৫% রিটার্ন দিয়েছে। সোনার দাম বৈশ্বিক ঘটনা এবং মুদ্রাস্ফীতির উপর নির্ভর করে ওঠানামা করে, কিন্তু ইক্যুইটি ফান্ড অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ সংকটের সময় সোনার দাম ২৫% বৃদ্ধি পায়, কিন্তু একই সময়ে ভারতীয় ইক্যুইটি বাজার (নিফটি ৫০) পতনের পর দ্রুত পুনরুদ্ধার করে ২০২১ সালে ২৪% রিটার্ন দেয়। এটি দেখায় যে, সোনা স্বল্পমেয়াদি নিরাপত্তা দিলেও, ইক্যুইটি ফান্ড দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত।
দুই সম্পদের ভূমিকা
সোনা এবং ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে পছন্দটি একে অপরের থেকে স্বাধীনভাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। ভাটনাগর বলেন, “একটি সুষম পোর্টফোলিওতে দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোনা অস্থির সময়ে স্থিতিশীলতা প্রদান করে, যখন ইক্যুইটি ফান্ড দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় প্রবৃদ্ধি দেয়।” তিনি পরামর্শ দেন যে, বিনিয়োগকারীদের তাদের পোর্টফোলিওর ৫-১০% সোনায় এবং বাকিটা ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করা উচিত, বিশেষ করে যদি তাদের লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি হয়।
বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
বাজারের অস্থিরতার সময় বিনিয়োগকারীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত:
- লক্ষ্য নির্ধারণ: আপনার আর্থিক লক্ষ্য কী? অবসর, সন্তানের শিক্ষা বা বাড়ি কেনার মতো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের জন্য ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড বেশি উপযোগী। স্বল্পমেয়াদি নিরাপত্তার জন্য সোনা বেছে নেওয়া যেতে পারে।
- ঝুঁকি সহনশীলতা: যদি আপনি ঝুঁকি নিতে অনীহা বোধ করেন, তবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। তবে, ঝুঁকি সহনশীলতা থাকলে ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।
- এসআইপি ব্যবহার: অস্থির বাজারে এসআইপির মাধ্যমে নিয়মিত বিনিয়োগ গড় ক্রয় মূল্য কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদি রিটার্ন বাড়ায়।
- বৈচিত্র্যকরণ: সোনা এবং ইক্যুইটি ফান্ডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ঝুঁকি কমায় এবং পোর্টফোলিওর স্থিতিশীলতা বাড়ায়।
বাজারের অস্থিরতার সময় সোনা এবং ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ড উভয়ই বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোনা স্বল্পমেয়াদি নিরাপত্তা এবং মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে হেজ প্রদান করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির জন্য ইক্যুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের কোনও বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত থাকার মাধ্যমে এই ফান্ডগুলো বিনিয়োগকারীদের মুদ্রাস্ফীতিকে পরাজিত করে বাস্তব সম্পদ তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই, বিনিয়োগকারীদের উচিত তাদের আর্থিক লক্ষ্য, ঝুঁকি সহনশীলতা এবং সময়সীমার উপর ভিত্তি করে সোনা এবং ইক্যুইটি ফান্ডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। একটি সুষম পোর্টফোলিওই অস্থির বাজারে স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি লাভ নিশ্চিত করতে পারে।