ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল (NSA Ajit Doval) রবিবার ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনএসসি) সেক্রেটারি ড. আলি আকবর আহমাদিয়ানের সঙ্গে একটি টেলিফোনিক আলোচনা করেছেন। এই আলোচনায় ডোভাল চাবাহার বন্দর এবং আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডর (আইএনএসটিসি) উন্নয়নে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্প্রসারণে ভারতের আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ভারতে অবস্থিত ইরানের দূতাবাস এক্স-এ একটি পোস্টে জানিয়েছে, “ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শ্রী অজিত ডোভাল ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি এবং সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি ড. আলি আকবর আহমাদিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনিক আলোচনা করেছেন।”
ইরানের দূতাবাসের পোস্টে আরও বলা হয়েছে, “আলোচনার সময়, ডোভাল অঞ্চলে ইরানের গঠনমূলক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন এবং চাবাহার বন্দর এবং আইএনএসটিসি-র উন্নয়নে বিশেষভাবে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্প্রসারণে ভারতের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি ইরানের অব্যাহত সহায়তা ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।” ইরানের প্রতিনিধি ড. আহমাদিয়ান জোর দিয়ে বলেছেন, ভারত এবং ইরান দুটি প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা ভাগ করে নেয়। তিনি কৌশলগত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন এবং বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে।
চাবাহার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব
ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ভারত, ইরান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সংযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বন্দর ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে সহজেই প্রবেশযোগ্য এবং পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের মাত্র ১৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত, যা চীনের বিনিয়োগে উন্নয়নাধীন। চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য একটি কৌশলগত বিকল্প হিসেবে কাজ করে, যা পাকিস্তানকে বাইপাস করে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও সংযোগ স্থাপনের সুযোগ প্রদান করে।
২০১৬ সালে ভারত, ইরান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা চাবাহার বন্দরকে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও ট্রানজিট করিডর হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারত এবং ইরান ১০ বছরের জন্য চাবাহার বন্দর পরিচালনার একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রকল্পে ভারতের ইন্ডিয়ান পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল) প্রায় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং আরও ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে সংগ্রহ করবে।
আইএনএসটিসি এবং আঞ্চলিক সংযোগ
আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডর (আইএনএসটিসি) হল ৭,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বহুমুখী পরিবহন প্রকল্প, যা ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক, রেল এবং সমুদ্রপথের সমন্বয়ে গঠিত। এই করিডরের মাধ্যমে ভারত থেকে রাশিয়া এবং ইউরোপে পণ্য পরিবহনের সময় ৪০% এবং খরচ ৩০% কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। চাবাহার বন্দর এই করিডরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করবে, যা মধ্য এশিয়ার সম্পদসমৃদ্ধ কিন্তু সমুদ্রপথবিহীন দেশগুলো, যেমন কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের জন্য ভারতীয় বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডোভাল গত অক্টোবরে কাজাখস্তানে অনুষ্ঠিত ভারত-মধ্য এশিয়া এনএসএ সভায় সমস্ত মধ্য এশিয়ার দেশকে চাবাহারের শহীদ বেহেশতি টার্মিনাল পুরোপুরি ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ভারত এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যে সরাসরি স্থলপথের অভাব একটি “সচেতন নীতি”র ফল, যা পাকিস্তানের দ্বারা আরোপিত। চাবাহার বন্দর এই বাধা অতিক্রম করতে এবং আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভারত-ইরান সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারত এবং ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক বছরে দুই দেশের সহযোগিতা বাণিজ্য, শক্তি, এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রসর হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ইরানের রাষ্ট্রপতি মাসুদ পেজেশকিয়ানের বৈঠক এই সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।
বৈদেশিক মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ৮ মে ইরানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশংসা করে বলেন, “গত কয়েক বছরে আমাদের সহযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে।” তিনি দিল্লিতে ২০তম ভারত-ইরান জয়েন্ট কমিশন মিটিং-এর উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের সম্পর্ককে আরও উন্নত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং রাষ্ট্রপতি পেজেশকিয়ান আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।”
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
চাবাহার বন্দর প্রকল্পের উন্নয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এই প্রকল্পের অগ্রগতিকে ধীর করে দিয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাবাহারের জন্য ভারতকে একটি বিরল নিষেধাজ্ঞা ছাড় দিয়েছে, তবুও সম্প্রতি ১০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষরের পর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। এছাড়া, ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অস্থিতিশীল সম্পর্ক এবং চীনের গোয়াদর বন্দরে বিনিয়োগ প্রকল্পটির জন্য প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।
তবে, ভারত এবং ইরানের যৌথ প্রচেষ্টা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। চাবাহার বন্দর ২০২৩ সালে আফগানিস্তানে ২০,০০০ টন গমের মানবিক সহায়তা পাঠাতে এবং ২০২১ সালে ইরানে পরিবেশবান্ধব কীটনাশক সরবরাহে ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রকল্পটি কেবল অর্থনৈতিক সুবিধাই নয়, বরং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে।
অজিত ডোভাল এবং আলি আকবর আহমাদিয়ানের মধ্যে সাম্প্রতিক আলোচনা ভারত-ইরান সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্বকে পুনরায় নিশ্চিত করেছে। চাবাহার বন্দর এবং আইএনএসটিসি-র উন্নয়ন ভারতের আঞ্চলিক সংযোগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই সহযোগিতা দুই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি মধ্য এশিয়া এবং তার বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে, চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।