মুখ্যমন্ত্রীর গ্রামে ‘প্রবেশ নিষেধ’ তৃণমূলের ভোট কুশলীর!

জন সুরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তথা একসময়ের তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে (Prashant Kishor) শনিবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পৈতৃক গ্রাম কল্যাণ বিঘায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।…

Prashant Kishor

জন সুরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা তথা একসময়ের তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে (Prashant Kishor) শনিবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পৈতৃক গ্রাম কল্যাণ বিঘায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর তীব্র বাক্যবিনিময়ের সূত্রপাত করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কিশোরের দলকে শুধুমাত্র বিহার শরীফের লেবার ওয়েলফেয়ার গ্রাউন্ডে জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, গ্রামে কোনও প্রচারের জন্য নয়। তবে, প্রশান্ত কিশোর এই বাধাকে ‘উপর থেকে নির্দেশিত’ বলে অভিযোগ করেছেন এবং এটিকে বিহারে রাজনৈতিক প্রচারে বাধা দেওয়ার একটি ‘নতুন ঐতিহ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কিশোরকে উপ-বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের (এসডিএম) সঙ্গে তর্কে জড়িত দেখা গেছে। বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই ঘটনা রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ঘটনার বিবরণ
প্রশান্ত কিশোর তাঁর দল জন সুরাজ পার্টির ‘স্বাক্ষর অভিযান’ নিয়ে নালন্দা জেলার কল্যাণ বিঘায় পৌঁছেছিলেন। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সরকারের প্রতিশ্রুতি, যেমন দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা, মহাদলিত পরিবারের জন্য জমি বিতরণ এবং চলমান জমি জরিপে স্বচ্ছতার বিষয়ে জনগণের মতামত সংগ্রহ করা। তবে, জেলা প্রশাসন তাঁকে গ্রামে প্রবেশ করতে বাধা দেয়, যা তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কিশোর এসডিএম-কে প্রশ্ন করছেন, “গত তিন কিলোমিটার ধরে কোনও গ্রামে আমাকে আটকানো হয়নি, কিন্তু কল্যাণ বিঘায় কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এটা কি উপর থেকে নির্দেশ?” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্নীতি এবং উন্নয়নের সুবিধা না পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন, যা প্রশাসনের দাবির বিপরীত।

   

এসডিএম জবাবে বলেন, “আমার উদ্দেশ্য আপনাকে আটকানো হলে বিহার শরীফেই আটকাতাম। কিন্তু আমরা অভিযোগ পেয়েছি, এই ধরনের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে।” কিশোর তৎক্ষণাৎ পাল্টা জবাব দেন, “আমরা আইন মান্য করি। আপনি যদি আমাকে নির্দেশ মানতে না বলেন, তাহলে কী করবেন? আপনি কি ভয় দেখানোর জন্য এখানে লোক জড়ো করেছেন?” তিনি প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘লোকতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত’ বলে বর্ণনা করেন।

প্রশাসনের বক্তব্য
নালন্দা জেলা প্রশাসন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জন সুরাজ পার্টিকে শুধুমাত্র বিহার শরীফের লেবার ওয়েলফেয়ার গ্রাউন্ডে জনসভার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বিবৃতিতে বলা হয়, “দলটি অননুমোদিত স্থানে সভা করার চেষ্টা করেছিল, যা তাদের আবেদনের শর্ত লঙ্ঘন করে।” প্রশাসন আরও জানায়, এই সমাবেশ জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে ছিল কিনা, তা তদন্ত করা হচ্ছে। তবে, কিশোর এই দাবিকে ‘আমলাতান্ত্রিক অতিরঞ্জন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “নীতীশজি এখানে ভালো রাস্তা তৈরি করেছেন, এটা বিহারের সর্বত্র মান হওয়া উচিত। কিন্তু এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে যে বিহারে কর্মকর্তারা ‘জঙ্গল রাজ’ চালাচ্ছেন।”

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই ঘটনা বিহারের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। বিধানসভা নির্বাচন মাত্র কয়েক মাস দূরে, এবং নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জেডি(ইউ)-আরজেডি জোটের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হচ্ছে। কিশোর, যিনি একসময় নীতীশ কুমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে তাঁর প্রচার কৌশলী ছিলেন, এখন তাঁর প্রবল সমালোচক। তিনি নীতীশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, উন্নয়নের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার অভিযোগ তুলে জনসাধারণের মধ্যে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

কিশোরের জন সুরাজ পার্টি বিহারের ২৪৩টি বিধানসভা আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। তিনি ইতিমধ্যেই রাঘোপুর আসন থেকে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর প্রচার কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সরকারের অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, যেমন জাতি জরিপের ভিত্তিতে ৯৪ লক্ষ দরিদ্র পরিবারের জন্য ২ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা এবং জমি জরিপে স্বচ্ছতা। কল্যাণ বিঘায় প্রবেশে বাধা পাওয়ার ঘটনা কিশোরের প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, কারণ তিনি এটিকে সরকারের ‘ভয়ের’ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন।

Advertisements

প্রশান্ত কিশোরের অভিযোগ
কিশোর অভিযোগ করেছেন যে নীতীশ কুমারের সরকার তাঁর রাজনৈতিক প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, “যদি গ্রামে যাওয়া অপরাধ হয়, তাহলে বিহারের ৪০ হাজার গ্রাম বন্ধ করে দিন। নীতীশ কুমারের সরকার এতটাই ভয় পেয়েছে যে তারা আমাকে তাঁর নিজের গ্রামে লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না।” তিনি আরও দাবি করেন যে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন এবং উন্নয়নের অভাব নিয়ে অভিযোগ জানাতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, এই নিষেধাজ্ঞা বিহারে গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত।

প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জন সুরাজ পার্টির সমর্থকরা এটিকে নীতীশ সরকারের ‘দমনমূলক নীতি’র প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। অন্যদিকে, জেডি(ইউ) নেতারা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কিশোর নির্বাচনের আগে নাটকীয়তার মাধ্যমে জনসমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিহারের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা কিশোরের প্রচারে সহানুভূতি অর্জনের সুযোগ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যুবক এবং উন্নয়নের অভাবে ক্ষুব্ধ ভোটারদের মধ্যে।

কিশোর ইতিমধ্যেই বিহার শরীফে একটি জনসভায় তাঁর স্বাক্ষর অভিযান শুরু করেছেন, যেখানে তিনি ১১ জুলাইয়ের মধ্যে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহের লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। এই স্বাক্ষরগুলো রাজ্যের রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে। তিনি জনগণকে লালু প্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন দলগুলোর পরিবর্তে ‘নতুন বিকল্প’ বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

কল্যাণ বিঘায় প্রশান্ত কিশোরের প্রবেশে বাধা বিহারের রাজনীতিতে একটি নতুন বিতর্কিত ঘটনা। এই ঘটনা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে। কিশোরের অভিযোগ এবং প্রশাসনের জবাব এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আগামী দিনগুলোতে এই ঘটনা কীভাবে বিহারের রাজনৈতিক সমীকরণকে প্রভাবিত করে, তা দেখার বিষয়। তবে, একটি বিষয় স্পষ্ট—প্রশান্ত কিশোর এই ঘটনাকে তাঁর প্রচারের জন্য ব্যবহার করতে কোনও কসুর করছেন না।