প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ও আবেগপূর্ণ ভাষণে ‘অপারেশন সিঁদুর’- (Operation Sindoor)এর সাফল্যকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইয়ে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি এই অভিযানকে জঙ্গিদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে একটি দৃঢ় বার্তা বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাষণে ছিল শক্তিশালী বক্তৃতা, আবেগময় আহ্বান এবং প্রতিপক্ষদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী।
পাকিস্তানের মাটিতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবিরোধী হামলার উল্লেখ করে মোদী বলেন, “ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানে জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে হামলা চালিয়েছে। জঙ্গিরা কল্পনাও করেনি যে ভারত এত বড় পদক্ষেপ নেবে… যখন ভারতীয় মিসাইল এবং ড্রোন পাকিস্তানের সেই ঘাঁটিগুলিতে আঘাত হেনেছে, তখন কেবল জঙ্গিদের ভবনই ধ্বংস হয়নি, তাদের সাহসও চূর্ণ হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী অপারেশনের নামের গভীর আবেগময় ও প্রতীকী তাৎপর্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “‘অপারেশন সিঁদুর’ কেবল একটি নাম নয়। এটি দেশের কোটি কোটি মানুষের অনুভূতির প্রতিফলন। অপারেশন সিঁদুর ন্যায়বিচারের একটি অবিচ্ছিন্ন প্রতিজ্ঞা।” তিনি আরও বলেন, “শত্রুরা এখন বুঝেছে আমাদের নারীদের কপাল থেকে সিঁদুর মুছে ফেলার পরিণতি কী। অপারেশন সিঁদুর শুধু একটি নাম ছিল না। আতঙ্কীরা আমাদের বোনদের সিঁদুর মুছে দিয়েছিল, তাই ভারত সন্ত্রাসের সদর দফতর ধ্বংস করে দিয়েছে।”
ভারতীয় বাহিনীর এই সাহসিকতাকে দেশের নারীদের উৎসর্গ করে মোদী বলেন, “আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর এই বীরত্ব দেশের মা, বোন এবং কন্যাদের উৎসর্গ করছি। আজ আমি এই সাহস, বীরত্ব এবং সংকল্প প্রতিটি মা, প্রতিটি বোন এবং প্রতিটি কন্যার নামে উৎসর্গ করছি।”
মোদী ২২ এপ্রিল পহেলগামে সংঘটিত নৃশংস জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে নিরীহ নাগরিকদের লক্ষ্য করে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “২২ এপ্রিল পহেলগামে জঙ্গিদের যে বর্বরতা প্রদর্শিত হয়েছিল, তা দেশ এবং বিশ্বকে হতবাক করেছে। যারা পরিবারের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করছিল, তাদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করে পরিবারের সামনে হত্যা করা হয়েছিল।” এই ঘটনা জাতীয় ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং অপারেশন সিঁদুরের সূচনা করে।
প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, ভারত আর কোনো হুমকি, এমনকি পারমাণবিক ভয় দেখানো সহ্য করবে না। তিনি বলেন, “এখন থেকে কোনো পারমাণবিক ভয়ভীতি সহ্য করা হবে না। ভারতের উপর জঙ্গি হামলার যোগ্য জবাব দিতে হবে, এবং সেই জবাব আমাদের শর্তে হবে।”
মোদী পাকিস্তানের “নোংরা সত্য” উন্মোচন করেন, বলেন, “বিশ্ব পাকিস্তানের সেই নোংরা সত্য দেখেছে, যখন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নিহত জঙ্গিদের বিদায় জানিয়েছেন। রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষিত সন্ত্রাসবাদের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে।”
অপারেশন সিঁদুর ভারতের শক্তি এবং সংযম প্রকাশ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “গত কয়েক দিনে আমরা দেশের ক্ষমতা এবং সংযম দেখেছি। প্রতিটি নাগরিকের পক্ষ থেকে আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে স্যালুট করি।”
অপারেশন সিঁদুরের বৃহত্তর তাৎপর্য তুলে ধরে মোদী বলেন, “অপারেশন সিঁদুর এখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের নতুন নীতি। একটি নতুন লাল রেখা টানা হয়েছে। আমরা জঙ্গিদের এবং তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের আলাদাভাবে দেখব না।”
ভারতের কৌশলগত পরিবর্তনের চূড়ান্ত ঘোষণায় তিনি বলেন, “আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে জঙ্গিদের নির্মূল করার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি। আজ প্রতিটি জঙ্গি, প্রতিটি জঙ্গি সংগঠন জানে যে আমাদের বোনদের, কন্যাদের কপাল থেকে সিঁদুর মুছে ফেলার পরিণতি কী। পাকিস্তান সীমান্তে আঘাতের প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু ভারত পাকিস্তানের বুকে আঘাত করেছে।”
১০০-এর বেশি জঙ্গি নিহত হওয়ায় মোদী এই মিশনকে একটি বিশাল সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “৭ মে, গোটা বিশ্ব আমাদের সংকল্পকে কার্যরূপে পরিণত হতে দেখেছে।”
অপারেশন সিঁদুরের তাৎপর্য
অপারেশন সিঁদুর কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী নীতির একটি নতুন দৃষ্টান্ত। এটি ভারতের সামরিক শক্তি, কৌশলগত সংযম এবং আবেগময় সংকল্পের একটি প্রতীক। পহেলগাম হামলার শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, এই অপারেশন ভারতকে বিশ্ব মঞ্চে একটি দায়িত্বশীল এবং শক্তিশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মোদীর ভাষণে স্পষ্ট হয়েছে যে অপারেশন সিঁদুর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি জঙ্গিদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কাছে একটি কঠোর সতর্কবাণী যে ভারত আর কোনো আক্রমণ সহ্য করবে না। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষিত সন্ত্রাসবাদের প্রমাণ তুলে ধরে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এর নিন্দা করার আহ্বান জানান।
ভারতের সামরিক শক্তি ও সংযম
অপারেশন সিঁদুর ভারতের সামরিক ক্ষমতা এবং সংযমের একটি উজ্জ্বল প্রদর্শন। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী নির্ভুল হামলার মাধ্যমে জঙ্গি ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করেছে, যখন পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হামলাগুলি ভারতের শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছে ব্যর্থ হয়েছে। মোদী এই সাফল্যের জন্য সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের প্রশংসা করেন, যারা এই অপারেশনকে সফল করতে একযোগে কাজ করেছেন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া
মোদীর ভাষণের পর বিশ্ব সম্প্রদায় ভারতের এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশ ভারতের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সমর্থন ভারতের কূটনৈতিক শক্তি এবং সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে তার নেতৃত্বের প্রমাণ।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণে অপারেশন সিঁদুর কেবল একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং ভারতের জাতীয় চেতনার প্রতিফলন হিসেবে উঠে এসেছে। এটি ভারতের সংকল্প, সাহস এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক। এই অপারেশন ভারতের জনগণের জন্য গর্বের মুহূর্ত এবং জঙ্গিদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবাণী। মোদীর শব্দে, “ভারত এখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। যারা আমাদের নারীদের সম্মানে আঘাত করবে, তাদের পরিণতি ভয়াবহ হবে।” অপারেশন সিঁদুর ভারতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।