ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে চিনর বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (NSA Ajit Doval)। এই উচ্চ-পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা গত ২২ এপ্রিল পাহালগামে সংঘটিত মারাত্মক জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে, যেখানে বেশ কয়েকজন ভারতীয় কর্মী নিহত হয়েছেন। চিনর বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুসারে, আলোচনার মূল বিষয় ছিল এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং শান্তি বজায় রাখার গুরুত্ব।
চিনর বিবৃতি অনুযায়ী, দোভাল পাহালগাম হামলাকে একটি গুরুতর ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য ছিল। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “যুদ্ধ ভারতের পছন্দ নয়” এবং ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি পুনরুদ্ধারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ কোনো পক্ষের স্বার্থে নয়, এবং ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে এবং অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
চিনর বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই পাহালগাম হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “এশিয়া অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কষ্টার্জিত এবং এটি মূল্যবান।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই চিনর প্রতিবেশী এবং একে অপরের প্রতিবেশী, তাই তাদের মধ্যে বিরোধ সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়ানো দরকার। ওয়াং ই দোভালের বক্তব্যের প্রশংসা করে বলেন, “চিন আপনার এই বক্তব্যের প্রশংসা করে যে যুদ্ধ ভারতের পছন্দ নয়।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, উভয় দেশ শান্ত ও সংযমী থাকবে এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে একটি “ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি” অর্জন করবে, যা উভয় দেশের মৌলিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু কূটনৈতিক আলোচনার এই ইতিবাচক সুরের বিপরীতে মাটির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। ভারত ও পাকিস্তান শনিবার (১০ মে ২০২৫) সন্ধ্যা ৫টা থেকে সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য একটি পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু এই সমঝোতার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিসরি শনিবার গভীর রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, পাকিস্তান সামরিক অপারেশনের মহাপরিচালকদের (ডিজিএমও) মাধ্যমে সম্মত যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করেছে। তিনি বলেন, “গত কয়েক ঘণ্টা ধরে পাকিস্তান এই সমঝোতা লঙ্ঘন করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই সীমান্ত অনুপ্রবেশের জবাব দিচ্ছে এবং এটি মোকাবিলা করছে।”
মিসরি পাকিস্তানের এই পদক্ষেপকে “অত্যন্ত নিন্দনীয়” হিসেবে অভিহিত করে পাকিস্তানকে এই লঙ্ঘন বন্ধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি নিশ্চিত করেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সীমানা ও নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর যেকোনো লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে মোকাবিলা করার নির্দেশ পেয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরে এদিকে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে। শ্রীনগর ও জম্মুতে ড্রোন দেখা যাওয়া এবং পরবর্তী বিস্ফোরণের ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। শ্রীনগরের বাটওয়ারা এলাকায়—যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা রয়েছে—একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। এই বায়বীয় অনুপ্রবেশের পর প্রায় ১৫ মিনিটের ব্যবধানে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে, যার আগে আকাশে ফ্লেয়ার বিস্ফোরণের আলো দেখা গেছে।
এই আকস্মিক উত্তেজনা নাগরিকদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর হতাশা প্রকাশ করে লিখেছেন, “এটি কোনো যুদ্ধবিরতি নয়। শ্রীনগরের মাঝখানে বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিটগুলো সক্রিয় হয়েছে। যুদ্ধবিরতির কী হলো? শ্রীনগর জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে!!”
সংঘাতের প্রেক্ষাপট
এই সংঘাতের পেছনে রয়েছে ২২ এপ্রিলের পাহালগাম জঙ্গি হামলা, যেখানে ২৬ জন, বেশিরভাগই পর্যটক, নিহত হয়েছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করেছে। এর জবাবে ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে, যেখানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি জঙ্গি ঘাঁটিতে নির্ভুল হামলা চালানো হয়। এই অভিযানে ১০০ জনেরও বেশি জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত।
পাকিস্তান অবশ্য দাবি করেছে, এই হামলায় ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং মসজিদের মতো বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করা হয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ শুরু করে, যার অধীনে তারা ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, ভারত তাদের নূর খান, রফিকি এবং মুরিদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁর মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের “প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণের” প্রশংসা করেছেন। তবে, পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এই প্রচেষ্টাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘাত বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক।” যুক্তরাজ্য, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও উভয় দেশকে সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার আহ্বান জানিয়েছে। চিন, যিনি পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, পাকিস্তানের “সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা” সমর্থন করার কথা বললেও, ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের এই লঙ্ঘনের জবাবে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। শ্রীনগরে ড্রোন ভূপাতিত করা এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করা ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার প্রমাণ। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় পাকিস্তানকে “দায়িত্বশীলভাবে” পরিস্থিতি মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছে। ভারত ইন্দু জল চুক্তি স্থগিত, পাকিস্তানি ক্রিকেটার ও সেলিব্রিটিদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক এবং বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে।
অজিত দোভাল এবং ওয়াং ইয়ের মধ্যে আলোচনা ভারতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করলেও, পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের কাশ্মীর বিরোধ এই সংঘাতের মূল কারণ। পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে যেকোনো ভুল গণনা বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং উভয় দেশের সংযম এই সংকট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে সংলাপের পথে ফিরতে হবে।