মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (US President Donald Trump) ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতে (India Pakistan conflict) “যত দ্রুত সম্ভব” ডি-এস্কেলেট হোক, এমনটাই চান বলে হোয়াইট হাউস শুক্রবার জানিয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিটের এই মন্তব্য এসেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা তীব্রতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে, যখন ভারত বুধবার ভোরে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অধীনে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি জঙ্গি ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই হামলা ছিল ২২ এপ্রিল পাহালগামে সংঘটিত নৃশংস হামলার প্রতিশোধ, যেখানে ২৬ জন, বেশিরভাগই পর্যটক, নিহত হয়েছিলেন।
লিভিট বলেন, “রাষ্ট্রপতি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তিনি এই সংঘাত যত দ্রুত সম্ভব ডি-এস্কেলেট হতে দেখতে চান। তিনি বুঝতে পারেন যে এই দুটি দেশ দশকের পর দশক ধরে একে অপরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আছে, এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওভাল অফিসে আসার অনেক আগে থেকেই।” তিনি আরও যোগ করেন, “এটি এমন একটি বিষয়, যেখানে বিদেশমন্ত্রী এবং এখন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মার্কো রুবিওও গভীরভাবে জড়িত।”
লিভিট এই মন্তব্য করছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা বা প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের জবাবে। তিনি বলেন, ট্রাম্পের “উভয় দেশের নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে” এবং রুবিও “উভয় দেশের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, এই সংঘাতের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছেন।”
বৃহস্পতিবার, মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মার্কো রুবিও পৃথকভাবে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি ডি-এস্কেলেশনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন এবং পাকিস্তানকে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি যেকোনো ধরনের সমর্থন বন্ধ করার জন্য কংক্রিট পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। জয়শঙ্কর রুবিওকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান যদি পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত করার চেষ্টা করে, তবে ভারত তা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করবে।
সংঘাতের পটভূমি
ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ ছিল পাহালগামে জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়া, যা ভারত পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম)-এর সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলাগুলো পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে এবং পিওকের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির এবং লঞ্চপ্যাডের উপর নির্ভুলভাবে পরিচালিত হয়েছে। ভারত রাফাল যুদ্ধবিমান থেকে স্কাল্প ক্রুজ মিসাইল এবং হ্যামার নির্ভুল-নির্দেশিত বোমা ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। পাকিস্তানের প্রাথমিক তদন্তে দাবি করা হয়েছে, ভারত সম্ভবত ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করেছে, যা শব্দের চেয়ে তিনগুণ দ্রুত গতিতে উড়ে এবং রাডারে ধরা কঠিন।
পাকিস্তান এই হামলাকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে অভিহিত করে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে। তারা দাবি করেছে, ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান তারা গুলি করে ভূপাতিত করেছে, যদিও ভারত এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল সশস্ত্র বাহিনীকে “প্রতিশোধ” নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন এই সংঘাতে সক্রিয় মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন, যদিও ভারত অতীতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিনয় মোহন কোয়াত্রা ফক্স নিউজকে বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আমাদের মার্কিন অংশীদারদের কাছে সবচেয়ে ভালো হবে যদি তারা পাকিস্তানকে জঙ্গিদের সমর্থন বন্ধ করতে বলে।” ভারত ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের লাহোর ঘোষণার উপর জোর দিয়ে বলেছে, দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা নেই।
মার্কিন বিদেশ দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানিয়েছেন, রুবিও উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং “যোগাযোগের লাইন খোলা রাখতে এবং এস্কেলেশন এড়াতে” উভয়কে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি পাহালগাম হামলার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন এবং ভারতের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে, পাকিস্তানের দাবি, ভারতের হামলায় বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে, যা মার্কিন প্রশাসন স্বীকার করেছে, যদিও ভারত বলছে, তাদের হামলা শুধুমাত্র জঙ্গিদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল।
ট্রাম্প বুধবার হোয়াইট হাউসে বলেছেন, “তারা যেসা-তেসা করে চলেছে, তাই আশা করি তারা এখন থামতে পারবে। আমি উভয় পক্ষকেই খুব ভালো করে জানি এবং চাই তারা এটি সমাধান করুক। আমি যদি কিছু করতে পারি, তবে আমি সেখানে থাকব।” তিনি এই উত্তেজনাকে “দুঃখজনক” বলে অভিহিত করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভারতের সামরিক অভিযানের বিষয়ে “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করেছেন এবং উভয় দেশকে “সামরিক সংঘাত এড়াতে” আহ্বান জানিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জাপানও উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শন এবং সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার আহ্বান জানিয়েছে। চীন, যিনি পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে জড়িত, এই সংঘাতে নিজেকে কূটনৈতিকভাবে সংযত রেখেছে। চীনের অস্ত্র পাকিস্তানের অস্ত্র আমদানির ৮১ শতাংশ গঠন করে, যা তাদের সামরিক সক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি
ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। ভারতের কাছে প্রায় ১৭২টি এবং পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে। ভারতের অগ্নি-৫ মিসাইল ৮,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে, যেখানে পাকিস্তানের নাসর মিসাইল ৭০ কিলোমিটার পরিসরে কৌশলগত পারমাণবিক হামলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ভারতের ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতি থাকলেও, সম্প্রতি এই নীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের কোনো এমন নীতি নেই। এই পারমাণবিক সক্ষমতা যেকোনো ভুল গণনাকে বিপজ্জনক করে তুলতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সিনিয়র বিশ্লেষক প্রবীণ দোনথি এনপিআরকে বলেন, “এই সংঘাতকে বিশ্ব গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে এটি বিশাল ঝুঁকির কারণ হতে পারে, কারণ উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। একটি ছোট ভুল বা ভুল গণনা এস্কেলেশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।” তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতার সম্ভাবনা
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে, ২০১৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পেও মধ্যস্থতা করে উভয় পক্ষকে পিছু হটতে রাজি করেছিলেন। পম্পেও তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক সংঘাতের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।” তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের বর্তমান প্রশাসন রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের মতো বিশ্বব্যাপী সংকটে ব্যস্ত, যা তাদের দক্ষিণ এশিয়ার এই সংকটে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সক্ষমতা সীমিত করতে পারে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের টিম উইলাসি-উইলসি বলেন, “ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বের পুলিশ হতে চায় না। তিনি সম্ভবত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি পাকিস্তানের চেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল।” তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে, যখন পাকিস্তান এখনও একটি মিত্র, যদিও ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের পর এর গুরুত্ব কমেছে।
ট্রাম্পের ডি-এস্কেলেশনের আহ্বান এবং রুবিওর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রতিফলিত করে। তবে, ভারতের দৃঢ় অবস্থান এবং পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হুমকি এই সংকটের সমাধানকে জটিল করে তুলেছে। উভয় দেশের পারমাণবিক সক্ষমতা এবং দীর্ঘদিনের বৈরিতা বিবেচনা করে, একটি ছোট ভুল বড় ধরনের সংঘাতের কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য শক্তির সমন্বিত প্রচেষ্টা এই সংকট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে সংলাপের পথে ফিরতে হবে, এবং এই প্রক্রিয়ায় মার্কিন মধ্যস্থতা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।