পাকিস্তান লালিত লস্কর-ই-তৈয়বা (LeT) নামক জঙ্গি সংগঠনের প্রাক্তন সদস্য নূর দাহরি (Noor Dahri) এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে এই গোষ্ঠীর প্রধান হাফিজ সৈয়দের (Hafiz Saeed) বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, হাফিজ সৈয়দ পাকিস্তানের হাজার হাজার নাগরিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী, যাদের তিনি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য “ছাইয়ের যুদ্ধে” প্রেরণ করেছেন। নূর দাহরি এই জঙ্গি সংগঠনকে ‘মৃত্যুর কাল্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, “যখন আমি এই মৃত্যুর কাল্ট থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখন এলইটি কমান্ডাররা আমাকে কাপুরুষ বলে সম্বোধন করেছিল।” নূর দাহরির এই প্রকাশ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলমান উত্তেজনা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।
নূর দাহরির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
নূর দাহরি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, তিনি তার মায়ের ইচ্ছানুযায়ী ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাফিজ সৈয়দের প্রভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ত্যাগ করে এলইটিতে যোগ দেন। তিনি বলেন, “আমি আমার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হাফিজ সৈয়দের প্রভাবে আমার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়।” নূরকে পাকিস্তানের মুরিদকে শহরে হাফিজ সৈয়দের স্থায়ী বাসভবন এবং প্রধান কার্যালয়ে তার দেহরক্ষীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন, হাফিজ সৈয়দ সে সময় একটি নীল রঙের টয়োটা ভিগো পিকআপ ড্যাটসান গাড়িতে ভ্রমণ করতেন, যার পেছনে আরামদায়ক ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল।
I aspired to become a doctor in accordance with my late mother’s wish, but I was unable to fulfil this ambition. Rather than pursuing a university education, I chose to join LeT, influenced by a man (Hafiz Saeed) who adversely impacted my promising future.
I recall being… pic.twitter.com/pkE2bcN0bN
— Noor Dahri – نور ڈاہری 🇬🇧 (@dahrinoor2) May 9, 2025
এলইটির প্রশিক্ষণ ও তৎপরতা
নূর দাহরি প্রকাশ করেছেন, হাফিজ সৈয়দের বক্তৃতা অনেক তরুণকে উদ্বুদ্ধ করত এবং তারা এলইটিতে যোগ দিত। এই তরুণরা পরবর্তীতে আফগানিস্তান এবং ভারতের কাশ্মীরে পাঠানো হত। তিনি জানান, এদের মধ্যে অনেকেই আর ফিরে আসেনি। নূর বলেন, “প্রতি বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৫০০ জন ব্যক্তি আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে অবস্থিত মা’আস্কার তৈয়বা নামক একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিতে যায়।” এই প্রকাশ থেকে বোঝা যায়, এলইটি শুধু পাকিস্তানে নয়, আফগানিস্তানেও তাদের জঙ্গি তৎপরতা পরিচালনা করছে।
নূর আরও বলেন, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) এলইটির প্রকৃত চেহারা তার কাছে স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, “আমি হাফিজ সৈয়দের লজ্জাজনক পরিণতি আমার জীবদ্দশায় দেখতে চাই।” তিনি এলইটিকে একটি ধ্বংসাত্মক সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “আমি এখন হাফিজ সৈয়দ আমার জন্য যে ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। আল্লাহ আমাকে ইসলামিস্টদের অন্ধকার চেহারা প্রকাশ করার জন্য বেছে নিয়েছেন।”
হাফিজ সৈয়দ: ভারতের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড
হাফিজ সৈয়দ জামাত-উদ-দাওয়া নামক নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রধান এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। এই হামলায় ১৬৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিল। হাফিজ সৈয়দের ছেলে তালহা সাঈদ এলইটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি সংগঠনের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) হাফিজ সৈয়দকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রেখেছে এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক জঙ্গি মামলা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে তার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রসংঘ নিরাপত্তা পরিষদও তাকে এবং জামাত-উদ-দাওয়াকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
পাকিস্তান সরকার ২০১৯ সাল থেকে হাফিজ সৈয়দকে কাগজে-কলমে গ্রেপ্তার দেখালেও, তিনি একাধিকবার জনসমক্ষে উপস্থিত হয়েছেন। ২০২২ সালে তাকে জঙ্গি অর্থায়নের দুটি মামলায় ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু সূত্র জানায়, তিনি লাহোরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করছেন। সম্প্রতি পহেলগাঁঁওয়ে ২৬ জনের প্রাণহানির জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তান তার নিরাপত্তা আরও জোরদার করেছে, কারণ এই হামলার জন্য এলইটির প্রক্সি সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) দায় স্বীকার করেছে।
এলইটির সাংগঠনিক কাঠামো ও তৎপরতা
এলইটি ১৯৮৫-৮৬ সালে হাফিজ সৈয়দ, জাফর ইকবাল এবং আব্দুল্লাহ আজ্জাম প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (ISI)-এর সমর্থনে পরিচালিত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির প্রধান লক্ষ্য কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করা। এলইটি ১৯৯৩ সাল থেকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ২০০১ সালের ভারতীয় সংসদ হামলা, ২০০৬ সালের মুম্বাই ট্রেন হামলা এবং ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা উল্লেখযোগ্য।
জামাত-উদ-দাওয়া (JUD) এলইটির প্রকাশ্য মুখোশ হিসেবে কাজ করে, যা স্কুল, হাসপাতাল এবং ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব বিস্তার করে এবং নিয়োগ ও র্যাডিক্যালাইজেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়। জেইউডির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ফালাহ-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশন (এফআইএফ), আল মদিনা এবং আইসার ফাউন্ডেশন নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া, মিলি মুসলিম লিগ (এমএমএল) এলইটির রাজনৈতিক শাখা হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।
নূর দাহরির প্রকাশের তাৎপর্য
নূর দাহরির প্রকাশ এলইটির অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম এবং হাফিজ সৈয়দের প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ইসলামিক থিওলজি অফ কাউন্টার টেররিজম’ (আইটিসিটি)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তার এই প্রকাশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক হতে পারে, কারণ এটি এলইটির প্রশিক্ষণ শিবির, নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং জঙ্গি তৎপরতার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরে।
নূর দাহরি আরও দাবি করেছেন, এলইটির কাছে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ প্রশিক্ষিত জঙ্গি রয়েছে, যা পাকিস্তানের মধ্যে এটিকে একটি শক্তিশালী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই তথ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রভাব এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সমর্থন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
হাফিজ সৈয়দের বিরুদ্ধে ভারত বারবার তার প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছে। পাকিস্তান যদিও তাকে কারাগারে রাখার দাবি করে, তবে তার জনসমক্ষে উপস্থিতি এবং জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ এই দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রসংঘ, এলইটি এবং জেইউডিকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে, চীন বারবার হাফিজ সৈয়দের ছেলে তালহা সাঈদকে রাষ্ট্রসংঘের জঙ্গি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে বাধা দিয়েছে।
নূর দাহরির প্রকাশ হাফিজ সৈয়দ এবং এলইটির জঙ্গি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য। তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সংগঠনের অভ্যন্তরীণ তথ্য প্রকাশ সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ এবং এর প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলমান উত্তেজনা এবং সাম্প্রতিক পহেলগাঁঁও হামলার প্রেক্ষাপটে এই প্রকাশ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হাফিজ সৈয়দের মতো জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন। নূর দাহরির মতো ব্যক্তিদের সাহসী প্রকাশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন আলোকপাত করছে।