অপারেশন সিঁদুরে দুই মহিলা সেনা অফিসারের প্রেস কনফারেন্সের কারণ ও তাৎপর্য কী?

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে (পিওকে) পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর (Operation Sindoor) বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেস কনফারেন্স নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রেস…

Women officers Indian Army,Colonel Sofia Qureshi, Wing Commander Vyomika Singh

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে (পিওকে) পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর (Operation Sindoor) বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেস কনফারেন্স নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রেস কনফারেন্সে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুই সিনিয়র মহিলা অফিসার—কর্নেল সোফিয়া কুরেশি (Colonel Sofia Qureshi) এবং ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং (Wing Commander Vyomika Singh )—অপারেশনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন।  এই অভিযান, যা গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও ২৬ জনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চালানো হয়েছে, ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের প্রতীক। দুই মহিলা অফিসারকে এই প্রেস কনফারেন্সের জন্য নির্বাচন করার কারণ ও তাৎপর্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, যা ভারতের নারী শক্তি এবং সাংস্কৃতিক বার্তার প্রতিফলন।

দুই মহিলা অফিসার নির্বাচনের কারণ

‘অপারেশন সিঁদুর’ পহেলগাঁও হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল, যেখানে পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের লক্ষ্য করে নৃশংস হামলা চালায়। এই হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন নববিবাহিত দম্পতি এবং অনেক মহিলা, যাদের স্বামীদের চোখের সামনে হত্যা করা হয়। হামলার একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্য ছিল হিমাংশী নরওয়ালের, যিনি মাত্র ছয় দিনের বিবাহিত জীবনের পর তার স্বামী, নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বিনয় নরওয়ালের দেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। হিমাংশীর কপালে সিঁদুরের অনুপস্থিতি জাতির মনকে নাড়া দিয়েছিল, কারণ সিঁদুর ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিবাহিত মহিলার সৌভাগ্যের প্রতীক। এই ঘটনা অপারেশনের নামকরণে প্রভাব ফেলে এবং প্রেস কনফারেন্সে দুই মহিলা অফিসারকে নির্বাচনের পিছনে এই সাংস্কৃতিক ও মানবিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

   

কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং-এর নির্বাচন ভারতের নারী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। পহেলগাঁও হামলায় মহিলারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, এবং তাদের দুঃখ ও ক্ষতি জাতীয় সংকল্পকে আরও দৃঢ় করেছে। দুই মহিলা অফিসারের মাধ্যমে এই অপারেশনের বিবরণ বিশ্বের কাছে তুলে ধরা একটি শক্তিশালী বার্তা—যে ভারতীয় নারীরা শুধু দুঃখের প্রতীক নয়, বরং প্রতিশোধ ও ন্যায়বিচারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এটি ভারতের সামরিক বাহিনীতে নারীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা এবং তাদের পেশাদারিত্বের প্রতি আস্থার প্রকাশ।

এছাড়াও, এই নির্বাচনের পিছনে একটি কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল। পাকিস্তান প্রায়ই ভারতের সামরিক পদক্ষেপকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে চিত্রিত করে। দুই মহিলা অফিসারের মাধ্যমে ব্রিফিং পরিচালনা করে ভারত বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে একটি নরম কিন্তু দৃঢ় বার্তা পৌঁছে দিয়েছে—এই অপারেশন শুধু সামরিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং নিরীহ নাগরিকদের, বিশেষ করে মহিলাদের, রক্ষার জন্য একটি নৈতিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের প্রচারণার বিরুদ্ধে একটি কূটনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবেও কাজ করে।

নির্বাচনের তাৎপর্য

দুই মহিলা অফিসারের প্রেস কনফারেন্সের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে নারীদের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব এবং তাদের নেতৃত্বের সক্ষমতার প্রকাশ। কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং উভয়েই তাদের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং সম্মানিত অফিসার। তাদের উপস্থিতি ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীতে নারীদের পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতার প্রতীক। এটি ভারতের তরুণীদের জন্যও একটি অনুপ্রেরণা, যারা সামরিক বাহিনীতে ক্যারিয়ার গড়তে চান।

দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচন সিঁদুরের সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকে তুলে ধরে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে সিঁদুর বিবাহিত মহিলার সৌভাগ্য ও সম্মানের প্রতীক। পহেলগাঁও নিহতদের মধ্যে অনেক মহিলার সিঁদুর মুছে যাওয়া জাতির জন্য একটি গভীর আঘাত। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণ এবং দুই মহিলা অফিসারের ব্রিফিং এই ক্ষতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। এটি ভারতের ঐতিহ্যবাহী যোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে কপালে সিঁদুরের তিলক পরতেন, ধর্ম ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

তৃতীয়ত, এই পদক্ষেপ ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের অংশ। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া, যেখানে তারা ভারতের হামলাকে ‘যুদ্ধের কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। দুই মহিলা অফিসারের মাধ্যমে ব্রিফিং বিশ্বের কাছে ভারতের সংযম এবং নৈতিক উচ্চতার বার্তা পৌঁছে দেয়। এটি পাকিস্তানের অভিযোগ—যেমন বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন—কে প্রতিহত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।

চতুর্থত, এই ঘটনা ভারতের সামরিক বাহিনীতে লিঙ্গ সমতার প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। অতীতে, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নারীদের ভূমিকা সীমিত ছিল, এবং যৌন হয়রানির মতো ঘটনা তাদের পেশাগত জীবনে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের যুদ্ধের ভূমিকা এবং নেতৃত্বের পদে নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্নেল কুরেশি এবং উইং কমান্ডার সিং-এর মতো অফিসারদের এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া এই অগ্রগতির প্রমাণ। এটি বিশ্বের কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে।

অপারেশন সিঁদুর ও প্রেস কনফারেন্স

‘অপারেশন সিঁদুর’ ৬ মে ভোর ১:৪৪ মিনিটে শুরু হয়, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে এবং পিওকে-র কোটলি, মুজাফফরাবাদসহ নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে নির্ভুল হামলা চালায়। এই হামলায় জৈশ-ই-মোহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈবা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করা হয়নি, এবং হামলাগুলো সুনির্দিষ্ট ও অ-উত্তেজনামূলক ছিল।

প্রেস কনফারেন্সে কর্নেল কুরেশি এবং উইং কমান্ডার সিং অপারেশনের কৌশলগত দিক, ব্যবহৃত অস্ত্র (যেমন স্কাল্প মিসাইল, হ্যামার বোমা এবং কামিকাজি ড্রোন) এবং এর সাফল্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেছেন। তাদের পেশাদার উপস্থাপনা এবং আত্মবিশ্বাস বিশ্ব মিডিয়ার প্রশংসা কুড়িয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিও এই ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন, যিনি পাকিস্তানের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংযোগের প্রমাণ তুলে ধরেন।

বৈশ্বিক প্রভাব

এই প্রেস কনফারেন্স ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপারেশন সম্পর্কে অবহিত করেছেন। ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রিউভেন আজার ভারতের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করেছেন। তবে, পাকিস্তান দাবি করেছে, হামলায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা ভারত অস্বীকার করেছে।

দুই মহিলা অফিসারের ব্রিফিং ভারতের নৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা বিশ্বে পৌঁছে দিয়েছে। এটি ভারতীয় নারীদের শক্তি, সাহস এবং নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ। ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং এই প্রেস কনফারেন্স ভারতের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা নারী শক্তি এবং জাতীয় সংকল্পের প্রতীক।

Advertisements