’৭১ ভারত-পাক যুদ্ধের বীরাঙ্গনা হোমগার্ড জ্যোতিবেন আজও দেশরক্ষায় প্রস্তুত

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা (India Pakistan Tension) ক্রমশ বাড়ছে। এই হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটক…

Jyotiben Upadhyay

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা (India Pakistan Tension) ক্রমশ বাড়ছে। এই হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটক প্রাণ হারিয়েছেন, যার ফলে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিদিন যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা চলছে, এবং দুই দেশই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারতে বাঙ্কার পরিষ্কার করা এবং মক ড্রিলের মতো কার্যক্রম চলছে, অন্যদিকে পাকিস্তান তাদের ঋণের অর্থ সামরিক মহড়ায় ব্যয় করছে। এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে অনেক প্রাক্তন সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবী দেশসেবার জন্য এগিয়ে আসছেন। এমনই একজন হলেন গুজরাটের ভুজের বাসিন্দা জ্যোতিবেন উপাধ্যায়, যিনি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে হোম গার্ড হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি আবারও দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

১৯৭১-এর যুদ্ধ: এক ঐতিহাসিক বিজয়

১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়, এবং তাদের সেনাবাহিনী সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে গুজরাটের ভুজের মহিলা হোম গার্ডরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার মধ্যে জ্যোতিবেন উপাধ্যায় এবং জ্যোতি কোঠারি অন্যতম।

   

জ্যোতিবেন উপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা

জ্যোতিবেন উপাধ্যায় স্মরণ করেন, ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি হোম গার্ড ইউনিটে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান ভুজে একদিনে ১৭টি বোমা ফেলেছিল, যার ফলে শহরে ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমরা মহিলা হোম গার্ডরা দলবদ্ধভাবে ভুজের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম এবং ভীত মানুষদের আশ্বাস দিতাম যে সবকিছু স্বাভাবিক আছে। আমাদের কাজ ছিল মানুষকে শান্ত রাখা এবং তাদের নিরাপদে থাকতে উৎসাহিত করা।” তিনি জানান, সেই সময়ে তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষের মধ্যে আতঙ্ক প্রতিরোধ করা এবং তাদের নিরাপত্তার অনুভূতি দেওয়া।

জ্যোতিবেন আরও বলেন, “আজকের পরিস্থিতি ১৯৭১-এর মতোই। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা প্রতিদিন বাড়ছে, এবং যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আমি আবারও দেশের সেবায় অংশ নিতে প্রস্তুত। বয়সের কারণে যদি আমাকে ডেস্ক জব দেওয়া হয়, তবুও আমি কাজ করতে চাই। এখন সময় মানুষকে সচেতন করার এবং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার।” তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ জাগানো এবং তাদের একত্রিত করা অত্যন্ত জরুরি।

জ্যোতি কোঠারির স্মৃতি ও আহ্বান

১৯৭১-এর যুদ্ধে হোম গার্ড হিসেবে কাজ করা জ্যোতি কোঠারি বলেন, “আমরা যখন হোম গার্ডের ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় বের হতাম, তখন গর্বে বুক ভরে যেত। আমাদের অস্ত্র চালানোর কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় মহিলাদের জন্য বাড়ির বাইরে পা রাখাও কঠিন ছিল, কিন্তু আমরা দেশের জন্য কাজ করে গর্বিত বোধ করতাম।” তিনি বর্তমান প্রজন্মের মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, “আজ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর দেশের জন্য এগিয়ে আসার সময় এসেছে। আমি মহিলাদের আহ্বান জানাচ্ছি, তারা দেশসেবায় অংশ নিন। আমরা আমাদের দলের সঙ্গে আলোচনা করেছি, এবং আমরা সবাই দেশের জন্য কিছু করতে প্রস্তুত।”

পহেলগাঁও হামলা ও বর্তমান উত্তেজনা

২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওর বৈসরণ উপত্যকায় জঙ্গিরা পর্যটকদের উপর হামলা চালায়, যাতে ২৬ জন নিহত হন। এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) প্রাথমিকভাবে দায় স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করে। ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ইন্দাস জলচুক্তি স্থগিত করেছে এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া, সীমান্তে উভয় দেশের মধ্যে গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে, যা উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ভুজের মহিলাদের অবদান

১৯৭১-এর যুদ্ধে ভুজের মহিলারা শুধু হোম গার্ড হিসেবে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবদান রেখেছিলেন। কানবাই শিবজি হিরানি নামে একজন মহিলা ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ারস্ট্রিপ পুনর্নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। তিনি পহেলগাঁও হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীকে পাকিস্তানে খাদ্য ও জল সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।” এই মহিলারা প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধের সময় শুধু সৈন্যরাই নয়, সাধারণ নাগরিকরাও দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বর্তমান প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ

বর্তমান উত্তেজনার মধ্যে ভারত সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক তল্লাশি চালাচ্ছে এবং সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বাড়ি ধ্বংস করছে। তবে, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এই ধ্বংসযজ্ঞের সমালোচনা করে বলেছেন, নিরপরাধ নাগরিকদের শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। এই পরিস্থিতিতে জ্যোতিবেন ও জ্যোতি কোঠারির মতো মহিলারা মানুষের মধ্যে সাহস ও ঐক্য জাগানোর গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।

মহিলাদের জন্য আহ্বান

জ্যোতি কোঠারি বিশেষভাবে মহিলাদের উদ্দেশে বলেন, “আমরা যখন ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় নামতাম, তখন আমাদের গর্বে বুক ফুলে যেত। আজও মহিলাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি ১৯৭১-এ পারি, তাহলে আজও পারব।” তিনি মনে করেন, মহিলারা শুধু দেশসেবায় নয়, সমাজে সচেতনতা ছড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। জ্যোতিবেনও বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেয়ার করা উচিত। আমরা মানুষকে শান্ত রাখতে এবং তাদের সাহস জোগাতে পারি।”

১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জ্যোতিবেন উপাধ্যায় এবং জ্যোতি কোঠারির মতো মহিলা হোম গার্ডরা প্রমাণ করেছিলেন যে, দেশসেবায় লিঙ্গ কোনো বাধা নয়। বর্তমানে পহেলগাঁও হামলার পর ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে তাদের আবারও দেশসেবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এই মহিলারা শুধু তাদের অতীত অবদানের জন্য নয়, বর্তমানে তাদের সাহস ও দৃঢ়তার জন্যও প্রশংসার যোগ্য। তাদের আহ্বান আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দেশের কঠিন সময়ে প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রজন্মের মহিলাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশসেবায় এগিয়ে আসা উচিত।

Advertisements