দিঘার ‘জগন্নাথ ধাম’ নাম নিয়ে ক্ষুব্ধ পুরীর রাজপরিবার

পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের তিতুলার প্রধান এবং পুরী রাজ পরিবারের গজপতি দিব্যসিংহ দেব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরকে “জগন্নাথ ধাম” (Jagannath Dham) হিসেবে উল্লেখ…

Puri Gajapati Opposes ‘Jagannath Dham’ Tag for Digha Temple, Cites Sentiment Violation

পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের তিতুলার প্রধান এবং পুরী রাজ পরিবারের গজপতি দিব্যসিংহ দেব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরকে “জগন্নাথ ধাম” (Jagannath Dham) হিসেবে উল্লেখ করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। একটি বিস্তারিত সাংবাদিক বিবৃতিতে গজপতি দিঘার মন্দির কর্তৃপক্ষকে “জগন্নাথ ধাম” বা “জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র” জাতীয় শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ধাম” শব্দটি ঐতিহ্যগতভাবে ১২শ শতাব্দীর পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের জন্য সংরক্ষিত, যা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই শব্দের অপব্যবহার বিশ্বব্যাপী ভক্তদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।

গজপতির বক্তব্য ও ধর্মীয় যুক্তি

   

গজপতি দিব্যসিংহ দেব তাঁর বিবৃতিতে স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ এবং পদ্ম পুরাণের মতো ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, শুধুমাত্র পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরই ভগবান জগন্নাথের চিরন্তন ও পবিত্র আবাস হিসেবে স্বীকৃত এবং এটিই “শ্রী জগন্নাথ ধাম” নামে অভিহিত হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, সনাতন ধর্মের বিভিন্ন ঐতিহ্যের ধর্মীয় নেতা ও আচার্যরা, যেমন আদি শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য এবং চৈতন্য মহাপ্রভু, পুরীকেই ভগবান জগন্নাথের ঐশ্বরিক আসন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

গজপতি জোর দিয়ে বলেছেন, শুধুমাত্র পুরীর মূল মন্দিরকেই “শ্রীমন্দির” বলা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, চতুর্ধা বিগ্রহ (জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা এবং সুদর্শন) শুধুমাত্র কাঠের মূর্তিতে পূজিত হওয়া উচিত, ধাতু বা পাথরে নয়। তিনি মুক্তিমণ্ডপ পণ্ডিত সভার অবস্থান উল্লেখ করে বলেছেন, শুধুমাত্র শ্রীমন্দিরে প্রস্তুত ভোগই “মহাপ্রসাদ” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দিঘার মন্দিরে এই ধরনের শব্দ বা প্রথার ব্যবহার ধর্মীয় ঐতিহ্যের অবমাননা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

দিঘার জগন্নাথ মন্দির ও বিতর্কের সূত্রপাত

বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে ৩০ এপ্রিল দিঘায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের পর। ২০ একর জমির উপর নির্মিত এই মন্দিরে পুরীর মতো কাঠের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং এর স্থাপত্যও পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দির থেকে অনুপ্রাণিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই মন্দিরকে “জগন্নাথ ধাম” হিসেবে প্রচার করছে, যা পুরীর গজপতি এবং ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

দিঘার মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে এবং এটি দিঘার সমুদ্র সৈকতের কাছে একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, “জগন্নাথ ধাম” নামকরণ এবং পুরীর সঙ্গে তুলনা করার প্রচেষ্টা ধর্মীয় সংবেদনশীলতার প্রশ্ন তুলেছে।

গজপতির আপত্তি ও ধর্মীয় তাৎপর্য

গজপতি দিব্যসিংহ দেব তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দির শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি সনাতন ধর্মের একটি প্রধান তীর্থক্ষেত্র, যা ভারতীয় সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বলেন, “পুরীর জগন্নাথ মন্দির ভগবান জগন্নাথের মূল আসন হিসেবে স্বীকৃত। অন্য কোনো মন্দিরকে ‘জগন্নাথ ধাম’ বা ‘শ্রীমন্দির’ বলা শাস্ত্র এবং ঐতিহ্যের পরিপন্থী।” তিনি আরও বলেন, এই ধরনের নামকরণ ভক্তদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং পুরীর মন্দিরের পবিত্রতা ও এককতার উপর আঘাত হানতে পারে।
গজপতি উল্লেখ করেছেন, শ্রী জগন্নাথের পূজা নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা শুধুমাত্র পুরীর মন্দিরে সম্পন্ন করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ, নবকলেবর এবং রথযাত্রার মতো অনুষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র পুরীতেই সম্পন্ন হয়। দিঘার মন্দিরে এই ধরনের আচার পালন করা সম্ভব নয়, তাই এটিকে “জগন্নাথ ধাম” বলা অযৌক্তিক বলে তিনি মনে করেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও গজপতির আপত্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধনের সময় বলেছিলেন, দিঘার মন্দিরটি পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিরূপ হিসেবে নির্মিত হয়েছে এবং এটি রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি বাড়াবে। তিনি এটিকে “পশ্চিমবঙ্গের জগন্নাথ ধাম” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, যা বিতর্কের সূত্রপাত করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মন্দিরটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করবে এবং দিঘাকে একটি ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তবে, গজপতির আপত্তির পর সরকার এই নামকরণের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

ভক্ত ও সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের ভক্ত এবং স্থানীয় সম্প্রদায় গজপতির অবস্থানকে সমর্থন করেছে। পুরীর মুক্তিমণ্ডপ পণ্ডিত সভা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন দিঘার মন্দিরের নামকরণের বিরোধিতা করে বিবৃতি জারি করেছে। ওড়িশার কিছু রাজনৈতিক নেতা এই ঘটনাকে “ধর্মীয় ঐতিহ্যের অপমান” হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু বাসিন্দা এই মন্দিরকে তাদের স্থানীয় গর্ব হিসেবে দেখছেন এবং এটিকে পুরীর সঙ্গে তুলনা করার বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখছেন না।

আইনি ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

গজপতির আপত্তি আইনি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, কারণ “জগন্নাথ ধাম” শব্দটি পুরীর মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। ওড়িশার কিছু আইনজীবী ইতিমধ্যে এই বিষয়ে আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। এছাড়া, এই বিতর্ক পুরী এবং দিঘার মধ্যে সাংস্কৃতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা দুই রাজ্যের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

দিঘার জগন্নাথ মন্দিরকে “জগন্নাথ ধাম” হিসেবে উল্লেখ করার বিরুদ্ধে পুরীর গজপতি দিব্যসিংহ দেবের আপত্তি ধর্মীয় সংবেদনশীলতা এবং ঐতিহ্য রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে। পুরীর শ্রী জগন্নাথ মন্দির ভারতীয় সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং এর এককতা রক্ষা করা ভক্তদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই আপত্তির পর নামকরণের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে, এই বিতর্ক ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আধুনিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।