ভারতে যে কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে বলে ফের শঙ্কা প্রকাশ পাক-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ (Khawaja Asif ) সোমবার…

Pakistan Defence Minister Khawaja Asif

পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ (Khawaja Asif ) সোমবার (৫ মে, ২০২৫) সতর্ক করে বলেছেন, ভারত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর যে কোনো মুহূর্তে সামরিক হামলা চালাতে পারে। ইসলামাবাদে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আসিফ বলেন, “খবর রয়েছে যে ভারত এলওসি বরাবর যে কোনো জায়গায় হামলা চালাতে পারে। নয়াদিল্লিকে যথাযথ জবাব দেওয়া হবে।” তিনি আরও জানান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ পহেলগাঁও ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

Also Read | ভারত-পাক উত্তেজনার মধ্যে দিল্লি পুলিশের ‘যুদ্ধ মহড়া’ প্রস্তুতি তুঙ্গে

   

পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সতর্কতা

ভারত জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্রমাগত সতর্কতা জারি করছে। গত সপ্তাহে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারার দাবি করেছিলেন যে, ভারত সম্ভবত ২৪-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে হামলা চালাতে পারে, এবং এই সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

সোমবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি “জাতীয় মর্যাদা এবং জনগণের সমৃদ্ধি রক্ষার জন্য পূর্ণ শক্তি দিয়ে জবাব দেবেন।” এই বক্তব্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি এবং দৃঢ় অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।

অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারত জঙ্গিদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে “দৃঢ় এবং নির্ণায়ক” পদক্ষেপ নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মোদী দেশের শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের “সম্পূর্ণ অপারেশনাল স্বাধীনতা” দিয়েছেন, যাতে তারা হামলার প্রতিক্রিয়ায় পদ্ধতি, লক্ষ্য এবং সময় নির্ধারণ করতে পারেন।

পহেলগাঁও হামলা ও উত্তেজনার পটভূমি

২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় সংঘটিত জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এটি ভারত-শাসিত কাশ্মীরে গত দুই দশকের মধ্যে পর্যটকদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা। হামলার দায় স্বীকার করেছিল দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যাকে পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা বলে মনে করা হয়। যদিও পাকিস্তান এই হামলায় কোনো ভূমিকা অস্বীকার করেছে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে, ভারত পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করেছে।

Also Read | পহেলগাঁও হামলায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ চাইল রাষ্ট্রসংঘ

হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬০ সালের ইন্দুস জল চুক্তি স্থগিত করা, আটারি সীমান্তে একমাত্র স্থল সংযোগ বন্ধ করা, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা সুবিধা বাতিল এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের স্তর হ্রাস। পাকিস্তানও প্রতিশোধমূলকভাবে ভারতীয় বিমানের জন্য নিজের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।

পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের সর্বশেষ সতর্কবার্তা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন পাকিস্তান ভারতের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করেছে। পাকিস্তান সিয়ালকট এবং লাহোর সেক্টরে নতুন রাডার সিস্টেম এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) ৬ষ্ঠ সাঁজোয়া ডিভিশন এবং ৭ম পদাতিক ডিভিশন সহ আর্টিলারি এবং চীনা উৎপত্তির মাল্টি-ব্যারেল রকেট লঞ্চার মোতায়েন করা হয়েছে। পাকিস্তান সম্প্রতি একটি মিসাইল পরীক্ষাও চালিয়েছে, যা উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে।

আসিফ গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ভারত যদি ইন্দুস নদীতে কোনো কাঠামো নির্মাণ করে, যা পাকিস্তানের কৃষি জমির ৮০ শতাংশের জন্য জল সরবরাহ করে, তবে তা “আগ্রাসন” হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পাকিস্তান সেই কাঠামো ধ্বংস করবে। তিনি এই ধরনের পদক্ষেপকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পহেলগাঁও হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শান্তির স্বার্থে জাতিসংঘের “সৌজন্যমূলক সেবা” প্রস্তাব করেছেন। গুতেরেস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন, উত্তেজনা হ্রাসে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইসরায়েল, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর এবং গ্রিস ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টায় সমর্থন জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও উভয় দেশকে “উত্তেজনা হ্রাস” করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে, চীন এবং কিছু আফ্রিকান ও মধ্য এশিয়ার দেশ হামলার নিন্দা জানাতে নীরব থেকেছে। ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, এবং সৌদি আরব উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করছে।

Also Read | ‘কুম্ভীরাশ্রু’ বলে মমতার মুর্শিদাবাদ সফরকে কটাক্ষ গিরিরাজের

ভারতের প্রস্তুতি

ভারত পহেলগাঁও হামলার জন্য পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ সংগ্রহ করছে। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) তদন্তে নেমেছে এবং তিনজন সন্দেহভাজন জঙ্গির পরিচয় প্রকাশ করেছে, যাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি এবং একজন ভারতীয়। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারের জন্য ২০ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করেছেন। ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) হামলার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এলওসি বরাবর পাকিস্তানের “অযাচিত ছোট অস্ত্রের গুলি”র জবাবে “দ্রুত এবং সমানুপাতিক” প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। ২০১৬ সালের উড়ি হামলা এবং ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং বিমান হামলা চালিয়েছিল। পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের কঠোর অবস্থান এবং পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি একটি সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

পহেলগাঁও হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের সতর্কবার্তা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কঠোর প্রতিক্রিয়া উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানালেও, এলওসি বরাবর সামরিক প্রস্তুতি এবং কূটনৈতিক ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। পহেলগাঁও হামলার দায়ীদের বিচার এবং কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি বড় চ্যালেঞ্জ।