পহেলগাঁওয়ে নৃশংস জঙ্গি হামলার জবাবে ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে। এবার চন্দ্রভাগা (chenab) নদীর উপর অবস্থিত বাগলিহার বাঁধের মাধ্যমে জলপ্রবাহ সাময়িকভাবে বন্ধ করল ভারত সরকার ।
কেন্দ্রীয় সরকার বান্দিপুরের কাছে কিশনগঙ্গা বাঁধেও অনুরূপ পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এই পদক্ষেপ সাময়িক, কারণ বাগলিহার বাঁধ সিন্ধু জল চুক্তির শর্ত মেনে নির্মিত এবং এটি সীমিত পরিমাণ জল ধরে রাখতে পারে, যার পরে জল ছাড়তে হয়। তবে, দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার মধ্যে এই পদক্ষেপ ইসলামাবাদের জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
চন্দ্রভাগা (chenab) নদী, যেখানে বাগলিহার বাঁধ অবস্থিত, সিন্ধু জল চুক্তির অধীনে একটি “পশ্চিমী নদী” হিসেবে বিবেচিত, এবং এই চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান এর অবাধ ব্যবহারের অধিকারী। ভারত এই নদীর জল কেবল কৃষি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বা অন্যান্য অ-ভোগ্য ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করতে পারে।
‘ফতেহ’ মিসাইল ছুঁড়ে চাপ বাড়াতে চাইছে পাকিস্তান, সতর্ক দিল্লি
বাগলিহার ও কিশনগঙ্গা প্রকল্প (chenab)
বাগলিহার প্রকল্পটি (chenab) জম্মু ও কাশ্মীরের রামবান জেলায় একটি রান-অফ-দ্য-রিভার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই ধরনের প্রকল্পে জল সঞ্চয়ের সামান্য বা কোনও ব্যবস্থা থাকে না। বর্তমানে এই প্রকল্পটি ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। প্রকল্পের প্রথম ধাপ ২০০৮ সালে এবং দ্বিতীয় ধাপ ২০১৫ সালে সম্পন্ন হয়।
কিশনগঙ্গা প্রকল্পটিও একটি রান-অফ-দ্য-রিভার প্রকল্প, যা কিশনগঙ্গা নদীর উপর গুরেজ উপত্যকায় অবস্থিত, লাইন অফ কন্ট্রোলের কাছে। এটির ক্ষমতা ৩৩০ মেগাওয়াট। পাকিস্তান উভয় প্রকল্পের নকশা ও পরিমিতি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল এই দাবি করে যে এগুলো সিন্ধু জল চুক্তি লঙ্ঘন করে। পাকিস্তানের মতে, বাগলিহার বাঁধের পরিমিতি সংঘাতের সময় ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে।
পাকিস্তানের আপত্তি ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ
বাগলিহার (chenab) প্রকল্প নিয়ে বহু দফা আলোচনার পরও সমঝোতা না হওয়ায় পাকিস্তান বিশ্বব্যাঙ্কের কাছে আপত্তি জানায়, যিনি এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী। বিশ্বব্যাঙ্কের নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ পাকিস্তানের কিছু আপত্তি মেনে নিলেও বাঁধের উচ্চতা এবং স্পিলওয়ের গেটেড নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করেন।
কিশনগঙ্গা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও পাকিস্তান আপত্তি তুলে দাবি করে যে ভারত একটি উপনদী থেকে অন্য উপনদীতে জল সরাতে পারে না। ইসলামাবাদ বিশ্বব্যাঙ্ক এবং একটি সালিশি আদালতে যায়, যা নয়া দিল্লির পক্ষে রায় দেয়।
সাময়িক পদক্ষেপ ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
ভারতের জলপ্রবাহ বন্ধের পদক্ষেপ সাময়িক, কারণ বাগলিহার বাঁধ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত জল ধরে রাখতে পারে। এরপর জল ছাড়তে হয়। দীর্ঘমেয়াদে জল বন্ধ করতে বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। পাকিস্তান পূর্বে সতর্ক করে বলেছিল যে ভারতের জল বন্ধের যেকোনো পদক্ষেপকে যুদ্ধের কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তারা সিমলা চুক্তিসহ সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে।
পহেলগাঁও হামলা ও দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা
পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিল সংঘটিত জঙ্গি হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন কাশ্মীরি নিহত হয়েছেন। এই হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও তলানিতে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “কার্গিল থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত এই হামলায় শোক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এটি কেবল নিরীহ পর্যটকদের উপর হামলা নয়, দেশের শত্রুরা ভারতের আত্মার উপর আঘাত করার সাহস দেখিয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “যারা এই হামলা চালিয়েছে এবং যারা এর পরিকল্পনা করেছে, তারা এমন শাস্তি পাবে যা তারা কল্পনাও করতে পারে না।”
তদন্তে এই হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র পাওয়া গেছে, যা পূর্বেও ভারতের মাটিতে একাধিক সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ। এই প্রেক্ষাপটে ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে এবং বাগলিহার বাঁধে জলপ্রবাহ বন্ধ করেছে।
রাজনৈতিক ও কৌশলগত তাৎপর্য
এই পদক্ষেপ ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি কঠোর কৌশলগত সতর্কবার্তা। সিন্ধু জল চুক্তি, যা ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল, পাকিস্তানের ৮০% কৃষি জমির জল সরবরাহ নিশ্চিত করে। ভারতের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে এই পদক্ষেপ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এক্স-এ পোস্টে বলা হয়েছে, “ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে এবং বাগলিহার ও সালাল বাঁধে (chenab) জলপ্রবাহ বন্ধ করেছে।” তবে, কিছু প্রতিবেদন ইঙ্গিত দেয় যে পাকিস্তানে নদীগুলির জলপ্রবাহ এখনও স্বাভাবিক রয়েছে, যা এই পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা এবং বাগলিহার বাঁধে জলপ্রবাহ বন্ধ করা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। যদিও এটি সাময়িক পদক্ষেপ, এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থানের প্রতীক।
কিশনগঙ্গা বাঁধে (chenab) অনুরূপ পদক্ষেপের পরিকল্পনা এই সংঘাতকে আরও জটিল করতে পারে। আগামী দিনে এই পদক্ষেপের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলবে।