জম্মু ও কাশ্মীরের পুঞ্চ (Poonch) জেলায় নিরাপত্তা বাহিনী একটি জঙ্গি আস্তানা উৎখাত করেছে, যার মাধ্যমে এই ইউনিয়ন টেরিটরিতে আরেকটি সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ব্যর্থ করা হয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর, যেখানে ২৬ জন নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের যৌথ অভিযানে পুঞ্চের সুরানকোট এলাকায় গতকাল সন্ধ্যায় এই আস্তানা থেকে একটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), দুটি রেডিও সেট এবং তিনটি কম্বল উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গিদের উপস্থিতি খুঁজে বের করার জন্য এলাকায় একটি তল্লাশি অভিযানও শুরু করা হয়েছে।
এই আস্তানা উৎখাতের কয়েক ঘণ্টা পরেই, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গত রাতে পুঞ্চ সহ অন্যান্য সেক্টরে লাইন অফ কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর “অপ্রীতিকর” গুলি চালানো শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “২০২৫ সালের ৪-৫ মে রাতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পোস্টগুলি কুপওয়ারা, বারামুল্লা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধর, নওশেরা, সুন্দরবানি এবং আখনুরের বিপরীতে এলওসি-র ওপার থেকে অপ্রীতিকরভাবে ছোট অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে এবং সমানুপাতিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।” এটি ছিল টানা ১১তম দিন যখন পাকিস্তান এলওসি-তে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
পহেলগাঁও গণহত্যার প্রেক্ষাপট
২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় পাঁচজন সশস্ত্র ইসলামপন্থী জঙ্গি পর্যটকদের উপর হামলা চালায়, যার ফলে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু পর্যটক, তবে একজন খ্রিস্টান পর্যটক এবং একজন স্থানীয় মুসলিমও নিহত হন। এই হামলাটি ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ভারতে বেসামরিক নাগরিকদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা হিসেবে বিবেচিত হয়। দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা বলে মনে করা হয়, প্রাথমিকভাবে এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। তারা দাবি করেছিল যে, ভারত সরকারের কাশ্মীরে ভারতীয় নাগরিকদের বসবাস ও কাজের অনুমতি দেওয়ার নীতির বিরোধিতায় এই হামলা চালানো হয়েছে। তবে, চার দিন পর তারা তাদের দায় স্বীকারের দাবি প্রত্যাহার করে নেয়।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করে, কারণ তদন্তে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের তদন্তে জানা গেছে যে, হামলাকারীদের মধ্যে তিনজন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য এবং তাদের মধ্যে অন্তত দুজন বিদেশী নাগরিক। এই তিনজনের স্কেচ প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তার বা নির্মূলের জন্য ৬০ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তদন্তে আরও জানা গেছে যে, এই হামলা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিল।
ভারত এই হামলার জবাবে কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা বাতিল করেছে এবং ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের তাৎক্ষণিকভাবে দেশ ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছে। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দুস জল চুক্তি স্থগিত করা হয়েছে এবং আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উভয় দেশ তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা হ্রাস করেছে, যার ফলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়েছে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে একটি “নিরপেক্ষ তদন্তের” আহ্বান জানিয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া
পহেলগাঁও হামলার পর থেকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি বাহিনী এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ যৌথভাবে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। পহেলগাঁওয়ে অস্থায়ী লকডাউন জারি করা হয়েছে এবং জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে ভারতীয় সেনার হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছে। কাশ্মীরে ১,৫০০-এর বেশি ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে এবং অন্তত ১০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির পরিবারের বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।
পুঞ্চে সাম্প্রতিক এই আস্তানা উৎখাতের ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রমাগত প্রচেষ্টার একটি অংশ। এর আগে, কুপওয়ারা জেলার সেদোরি নালা এলাকায় আরেকটি জঙ্গি আস্তানা থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল। এই অভিযানগুলি জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার এবং ভবিষ্যতের হামলা প্রতিরোধের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পহেলগাঁও হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ একটি সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন, যেখানে এই নৃশংস হামলার নিন্দা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে এই হামলাকে “কাশ্মীরিয়ত এবং ভারতের ধারণার উপর আঘাত” হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই হামলার নিন্দা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইইউ প্রধান উরসুলা ফন ডের লেইন এই হামলার নিন্দা করে ভারতের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
পুঞ্চে জঙ্গি আস্তানা উৎখাত এবং বোমা উদ্ধারের ঘটনা জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্কতা এবং কার্যকারিতার প্রমাণ। পহেলগাঁও গণহত্যার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা তীব্র হয়েছে, এবং এলওসি-তে পাকিস্তানের ক্রমাগত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ভারতের কঠোর কূটনৈতিক এবং সামরিক পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। তবে, এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে জঙ্গি নেটওয়ার্কের সম্পূর্ণ নির্মূল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।