আর ব্র্যান্ড নয়! সস্তা জেনেরিক ওষুধ লেখার নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের

ডাক্তারদের শুধুমাত্র জেনেরিক ওষুধ (Generic Drug) লিখতে হবে এবং কোনও নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করা যাবে না—এমনই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজস্থানে ইতিমধ্যে এই নিয়ম…

Supreme Court Bats for Mandatory Generic Drug Prescription Across India

ডাক্তারদের শুধুমাত্র জেনেরিক ওষুধ (Generic Drug) লিখতে হবে এবং কোনও নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করা যাবে না—এমনই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজস্থানে ইতিমধ্যে এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির অসৎ বিপণন কৌশল নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ের করা একটি পিটিশনের শুনানির সময় এই মন্তব্য করেন বিচারপতি সন্দীপ মেহতা। তিনি বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং বিচারপতি সঞ্জয় কারোলের সঙ্গে তিন বিচারপতির বেঞ্চে ছিলেন। এই নির্দেশ যদি সারা দেশে কার্যকর হয়, তবে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে আদালত।

পিটিশনের প্রধান অভিযোগ
পিটিশনে বলা হয়েছে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি ডাক্তারদের ঘুষ দিয়ে অতিরিক্ত বা অযৌক্তিক ওষুধ লিখতে প্ররোচিত করছে এবং ব্যয়বহুল ব্র্যান্ডের ওষুধ বিক্রির জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং অতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি ওষুধের উপর নির্ভরতাও তৈরি করছে। পিটিশনে আরও দাবি করা হয়েছে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ডাক্তারদের বিনামূল্যে উপহার (ফ্রিবি) প্রদানের জন্য দায়বদ্ধতা আরোপ করা উচিত।

   

এর আগের শুনানিতে, ফেডারেশন অফ মেডিক্যাল অ্যান্ড সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (এফএমআরএআই)-এর আইনজীবী একটি জনপ্রিয় জ্বরের ওষুধের প্রস্তুতকারকের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ওই কোম্পানি ডাক্তারদের জন্য ১,০০০ কোটি টাকার ফ্রিবি ব্যয় করেছে। এই অভিযোগটি সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিডিটি)-এর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। এই ধরনের অভিযোগ ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের অসৎ কার্যকলাপের গভীরতা প্রকাশ করে।

জেনেরিক ওষুধের পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট
সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, ডাক্তারদের জন্য জেনেরিক ওষুধ লেখার বিষয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ নির্দেশ জারি করা হলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির ডাক্তারদের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ সমাধান হবে। আদালত বলেছে, “এটি আপনার প্রার্থনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজস্থানে এখন একটি নির্বাহী নির্দেশ রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি চিকিৎসা পেশাদারকে জেনেরিক ওষুধ লিখতে হবে। তারা কোনও কোম্পানির নাম উল্লেখ করতে পারবেন না। এটি সমস্যার সমাধান করবে।”

জেনেরিক ওষুধ হল সেই ওষুধ, যার রাসায়নিক গঠন ব্র্যান্ডেড ওষুধের মতোই, কিন্তু এগুলি সাধারণত অনেক কম দামে পাওয়া যায়। ব্র্যান্ডেড ওষুধের বিপণন এবং বিজ্ঞাপন ব্যয়ের কারণে তাদের দাম বেশি হয়, যা সাধারণ মানুষের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। জেনেরিক ওষুধের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে চিকিৎসার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং রোগীরা সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবেন।

রাজস্থানের মডেল: একটি পথপ্রদর্শক
রাজস্থানে ইতিমধ্যে জেনেরিক ওষুধ লেখার নির্দেশ কার্যকর হয়েছে, যা সারা দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। এই নিয়ম অনুযায়ী, ডাক্তাররা ওষুধের রাসায়নিক নাম লিখবেন, ব্র্যান্ডের নাম নয়। এটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির প্রভাব কমাবে এবং রোগীদের জন্য ওষুধের দাম কমিয়ে দেবে। সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, এই মডেলটি জাতীয় স্তরে প্রয়োগ করা হলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের অসৎ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ফ্রিবি: একটি গুরুতর সমস্যা
পিটিশনে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ডাক্তারদের বিনামূল্যে উপহার দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই উপহারের মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে ছুটি, ব্যয়বহুল গ্যাজেট, এমনকি নগদ অর্থ। এই ধরনের কার্যকলাপ ডাক্তারদের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এবং তারা প্রায়ই রোগীদের জন্য অপ্রয়োজনীয় বা ব্যয়বহুল ওষুধ লিখে থাকেন। এটি শুধু চিকিৎসার ব্যয় বাড়ায় না, বরং রোগীদের স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে।

জেনেরিক ওষুধের সুবিধা
জেনেরিক ওষুধের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। প্রথমত, এটি রোগীদের জন্য ওষুধের ব্যয় কমাবে, বিশেষ করে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য। দ্বিতীয়ত, এটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির অসৎ বিপণন কৌশলকে নিরুৎসাহিত করবে। তৃতীয়ত, জেনেরিক ওষুধের ব্যবহার ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার বা নির্ভরতার সমস্যা কমাতে সাহায্য করবে। এছাড়া, এটি সরকারি হাসপাতাল এবং জনঔষধি কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়াবে।

সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা
ভারত সরকার ইতিমধ্যে জনঔষধি কেন্দ্রের মাধ্যমে জেনেরিক ওষুধের প্রচার করছে, যেখানে ব্র্যান্ডেড ওষুধের তুলনায় অনেক কম দামে ওষুধ পাওয়া যায়। তবে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন এবং কঠোর প্রয়োগ ব্যবস্থা প্রয়োজন। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির উপর নজরদারি বাড়াতে এবং তাদের ফ্রিবি প্রদানের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (সিডিএসসিও)-এর মতো সংস্থাগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং সাশ্রয়ীতা আনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। জেনেরিক ওষুধ লেখার নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির অসৎ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। রাজস্থানের মডেলটি সারা দেশে প্রয়োগ করা হলে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের সংস্কার আসবে। এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং চিকিৎসক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এটি কেবল রোগীদের জন্যই নয়, বরং চিকিৎসা পেশার সততা এবং নৈতিকতা পুনরুদ্ধারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।ো