বিদেশি ছয় প্রতিরক্ষা সংস্থাকে তিন বছরের নিষেধাজ্ঞা ভারতের

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Defence Ministry) ছয়টি প্রতিরক্ষা সংস্থার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের…

Defence Ministry Extends Ban on Six Foreign Defence Firms Till 2028

ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Defence Ministry) ছয়টি প্রতিরক্ষা সংস্থার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবে না। নিষিদ্ধ সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর টেকনোলজিস কাইনেটিক্স লিমিটেড (এসটিকে), ইসরায়েল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (আইএমআই), টিএস কিষাণ অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, আরকে মেশিন টুলস লিমিটেড, রাইনমেটাল এয়ার ডিফেন্স (জুরিখ), এবং কর্পোরেশন ডিফেন্স (রাশিয়া)। এই সিদ্ধান্তটি ৩০ এপ্রিল ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং ১১ এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে।

এই সংস্থাগুলি প্রথমে ১১ এপ্রিল ২০২২ থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসা করা থেকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। ২০২২ সালে এই নিষেধাজ্ঞা আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়। বর্তমানে ঘোষিত এই সম্প্রসারণের ফলে নিষেধাজ্ঞা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক নির্দেশে বলা হয়েছে, “এই সিদ্ধান্তের কঠোরভাবে পালন নিশ্চিত করার জন্য মন্ত্রণালয়ের সমস্ত শাখা এবং সার্ভিস হেডকোয়ার্টার্সকে অনুরোধ করা হচ্ছে।”

   

নিষেধাজ্ঞার পটভূমি

এই নিষেধাজ্ঞার শিকড় রয়েছে ২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া একটি দুর্নীতির ঘটনায়, যেখানে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের (ওএফবি) প্রাক্তন মহাপরিচালক সুদীপ্ত ঘোষের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) ঘোষকে গ্রেপ্তার করার পর তদন্তে উঠে আসে এই ছয়টি সংস্থার নাম। সিবিআই এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য নোটিশ জারি করেছিল। তবে, সংস্থাগুলির জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় ২০১২ সালে তাদের ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।

নিষিদ্ধ সংস্থাগুলির বিবরণ

১. সিঙ্গাপুর টেকনোলজিস কাইনেটিক্স লিমিটেড (এসটিকে): এই সংস্থাটি সিঙ্গাপুরের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী। এটি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ৮,০০০ কোটি টাকার ১৫৫ মিমি, ৫২ ক্যালিবার টোয়েড আর্টিলারি গান এবং ৩,০০০ কোটি টাকার ১৪০টি আল্ট্রা-লাইট হাউইটজার সরবরাহের দরপত্রে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

২. ইসরায়েল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (আইএমআই): ইসরায়েলের এই সংস্থাটি নলন্দায় ওএফবি-র সঙ্গে অংশীদারিত্বে বোফোর্স শেলের জন্য ফিউজ উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের কাজে জড়িত ছিল। নিষেধাজ্ঞার কারণে এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।

৩. টিএস কিষাণ অ্যান্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড: নতুন দিল্লির এই ভারতীয় সংস্থাটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহে জড়িত ছিল।

৪. আরকে মেশিন টুলস লিমিটেড: লুধিয়ানার এই ভারতীয় সংস্থাটিও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে কাজ করত।

৫. রাইনমেটাল এয়ার ডিফেন্স (জুরিখ): সুইজারল্যান্ডের এই সংস্থাটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষজ্ঞ। এটি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছিল।

৬. কর্পোরেশন ডিফেন্স (রাশিয়া): রাশিয়ার এই সংস্থাটি ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজের নিষেধাজ্ঞার কারণে নলন্দায় বোফোর্স শেলের ফিউজ উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, সিঙ্গাপুর টেকনোলজিস কাইনেটিক্স এবং রাইনমেটালের নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য আর্টিলারি গান ক্রয়ের ক্ষেত্রে পছন্দের সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। ভারত ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে বোফোর্স কেলেঙ্কারির পর থেকে নতুন প্রজন্মের আর্টিলারি গান ক্রয় করতে পারেনি, এবং এই নিষেধাজ্ঞা এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সংস্থাগুলির মধ্যে কিছু তাদের ক্ষেত্রে একচেটিয়া সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। ফলে, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা প্রয়োজনীয়তার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকের মতে, সরকারের উচিত ছিল এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা, যাতে প্রতিরক্ষা ক্রয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

সংস্থাগুলির প্রতিক্রিয়া

নিষিদ্ধ সংস্থাগুলির মধ্যে রাইনমেটাল এয়ার ডিফেন্স তাদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। সংস্থাটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগের বিস্তারিত তথ্য এবং স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। একইভাবে, সিঙ্গাপুর টেকনোলজিস কাইনেটিক্স তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের উপর ‘অন্যায্য নিষেধাজ্ঞা’র বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে তিনটি পিটিশন দাখিল করেছিল।

ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি ও স্বচ্ছতা

এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। তবে, কিছু সংস্থার অভিযোগ যে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানানো হয়নি, তা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যখন বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন ঘটায়। তবে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হতে পারে। সরকারকে এখন বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এই নিষেধাজ্ঞা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নির্ভর করবে সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনার উপর।