ভারতের সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court) অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (AIFF )-এর খসড়া সংবিধান নিয়ে চলমান মামলায় ভারত সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। মঙ্গলবার বিচারপতি পিএস নরসিমহা এবং জয়মাল্য বাগচীর সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ভারত সরকারের প্রতিনিধি, সলিসিটর জেনারেল কেএম নটরাজের পর্যবেক্ষণ এবং ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (FSDL) ও এআইএফএফ-এর আইনজীবীদের কিছু চূড়ান্ত মন্তব্য শুনেছে। এই মামলার পরবর্তী শুনানি ৩০ এপ্রিল বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত হবে। ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ গঠনে এই মামলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত সরকারের অবস্থান
ভারত সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল কেএম নটরাজ এআইএফএফ-কে জাতীয় ক্রীড়া কোড (স্পোর্টস কোড) মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এআইএফএফ-সহ প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থার প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং খেলোয়াড়দের স্বার্থ রক্ষার জন্য স্পোর্টস কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করা উচিত। নটরাজ আরও বলেন, ভারত ২০৩৬ সালের অলিম্পিক আয়োজনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ক্ষেত্রে লবিং এবং বিভিন্ন দেশের সমর্থন প্রয়োজন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দক্ষ ও শক্তিশালী ক্রীড়া প্রশাসকদের সিস্টেমে প্রবেশ করতে হবে। তিনি বলেন, “আমাদের দক্ষ ক্রীড়া প্রশাসক প্রয়োজন। তাদের সিস্টেমে প্রবেশ করতে হবে।”
নটরাজ বিচারপতি নাগেশ্বর রাও প্রণীত খসড়া সংবিধানের অযোগ্যতা সংক্রান্ত ধারা নিয়েও মতামত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কেবলমাত্র অভিযোগ গঠনের ভিত্তিতে কাউকে পদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না। “নির্দোষতার ধারণা সবসময় থাকে। বিশেষ করে এই ধরনের সংস্থা বা জনজীবনে, কেবল অভিযোগ গঠনের কারণে কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না,” বলে তিনি মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত হয়ে বলে, “কেবল দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ভিত্তিতে কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না, সাজা ঘোষণা হতে হবে।”
প্রোমোশন এবং রেলিগেশন নিয়ে আলোচনা
শুনানির সময় এফএসডিএল-এর প্রতিনিধিত্বকারী সিনিয়র কাউন্সেল নীরজ কাউলকে চূড়ান্ত মন্তব্য করার সুযোগ দেওয়া হয়। কাউল স্বীকার করেন যে প্রোমোশন এবং রেলিগেশন নিয়ে তার পূর্ববর্তী মন্তব্য ভুলভাবে বোঝা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এফএসডিএল প্রোমোশন এবং রেলিগেশনের বিরোধী নয়। তিনি বলেন, “দিল্লি এফসি প্রোমোশন এবং রেলিগেশন নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলেছে, কিন্তু এই ক্লাবই আই-লিগে চিঠি দিয়ে বলেছে যে এই মৌসুমে রেলিগেশন থাকা উচিত নয়। আমরা সবাই শেষ পর্যন্ত আইএসএল-এ রেলিগেশন চালু করতে চাই।”
কাউল আরও বলেন, “এই বিষয়টি সংবিধানের অংশ হতে হবে, এই জোর দেওয়াটাই ভুল। নির্বাচিত সংস্থা চাইলে এটি গ্রহণ করতে পারে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে এফএসডিএল ভারতীয় ফুটবলের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তৃণমূল স্তরে ফুটবল প্রচারের জন্য তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে ক্রীড়া কর্মসূচি শুরু করেছে। তিনি আদালতের কাছে আবেদন করে বলেন, “অন্য পক্ষ যেভাবে আমাদের নিন্দা করছে, দয়া করে আমাদের সেভাবে নিন্দা করবেন না।”
এআইএফএফ-এর মন্তব্য
এআইএফএফ-এর প্রতিনিধিত্বকারী একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেটকেও চূড়ান্ত মন্তব্য করার সুযোগ দেওয়া হয়। তিনি জানান, দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে উল্লিখিত ১৩টি ত্রুটির প্রতিটির জবাব এআইএфএফ দিয়েছে, যা সিনিয়র অ্যাডভোকেট রাহুল মেহরা উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া, এআইএফএফ-এর প্রতিনিধি ডেলয়েট পরিচালিত ফরেনসিক অডিট রিপোর্টে উল্লিখিত অনিয়মকারী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশের জন্য আদালতের কাছে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, “ডেলয়েটের ফরেনসিক অডিট রিপোর্টটি সিল করা খামে শ্রদ্ধেয় আমিকাস এবং সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে। আমরা অনুরোধ করছি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হোক যাতে এআইএফএফ যথাযথ তদন্ত পরিচালনা করতে পারে।”
মামলার প্রেক্ষাপট
এআইএফএফ-এর খসড়া সংবিধান নিয়ে এই মামলার শিকড় ২০২২ সালের মে মাসে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রফুল প্যাটেল এবং তার নির্বাহী কমিটিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনিক ভূমিকা থেকে সরিয়ে দেয়। জাতীয় ক্রীড়া কোড অনুযায়ী তিনটি চার বছরের মেয়াদ শেষ করার পরও নির্বাচন না করায় প্যাটেল পুনর্নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হন। এরপর বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, সূর্য কান্ত এবং পিএস নরসিমহার বেঞ্চ একটি তিন সদস্যের প্রশাসক কমিটি (সিওএ) নিয়োগ করে এআইএফএফ-এর দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। ২০২২ সালের ১৫ জুলাই সিওএ এআইএফএফ-এর জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেয়।
খসড়া সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৪ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে কমপক্ষে পাঁচজন প্রাক্তন জাতীয় খেলোয়াড়ের অন্তর্ভুক্তি এবং অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে বর্তমান পদাধিকারীদের অপসারণের বিধান। তবে, একাধিক আপত্তির কারণে এই খসড়া সংবিধানের অনুমোদন বিলম্বিত হয়েছে।
AIFF-এর ভূমিকা
এফএসডিএল, যারা বর্তমানে এআইএফএফ-এর সঙ্গে যৌথভাবে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) পরিচালনা করে, তারা আইএসএল-এর নিয়ন্ত্রণ এআইএফএফ-এর হাতে ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক। তবে, তারা বিনিময়ে ব্যক্তিগত ক্লাবগুলির অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া এবং পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ চায়। এছাড়া, এফএসডিএল প্রোমোশন এবং রেলিগেশনের বিধান খসড়া সংবিধান থেকে সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছে, যা ফিফা এবং এএফসি নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচিত হয়েছে।
এআইএফএফ-এর খসড়া সংবিধান নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই মামলা ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকারের জাতীয় ক্রীড়া কোড মেনে চলার আহ্বান এবং এফএসডিএল-এর প্রোমোশন-রেলিগেশন নিয়ে অবস্থান ভারতীয় ফুটবলের প্রশাসনিক কাঠামো এবং প্রতিযোগিতামূলক কাঠামোর উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ৩০ এপ্রিলের শুনানি এই দীর্ঘস্থায়ী মামলার সমাধানের দিকে একটি নির্ণায়ক পদক্ষেপ হতে পারে। ভারতীয় ফুটবল সমর্থকরা আশা করছেন, নতুন সংবিধান ফুটবলের উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদান করবে।
দ্রষ্টব্য: মামলার সর্বশেষ তথ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র যাচাই করুন।