আর্সেনাল গত রবিবার ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত উইমেন্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগের (Women’s Champions League) সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে অলিম্পিক লিয়ঁকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেছে। এই জয়ের মাধ্যমে ইংলিশ ক্লাবটি আগামী মাসে লিসবনে বার্সেলোনার বিপক্ষে ফাইনালে উঠেছে। প্রথম লেগে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা আর্সেনালকে রেকর্ড আটবারের চ্যাম্পিয়ন লিয়ঁর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছিল। ম্যাচের শুরুতে লিয়ঁর গোলকিপার ক্রিস্টিয়ান এন্ডলারের আত্মঘাতী গোলের মাধ্যমে তারা মোট স্কোরে সমতা ফেরায়। এরপর স্পেনের তারকা মারিওনা ক্যালডেনটি প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে দুর্দান্ত গোল করে আর্সেনালকে এগিয়ে দেন। দ্বিতীয়ার্ধে আর্সেনাল পুরোপুরি খেলার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ম্যাচটিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মধ্যে অ্যালেসিয়া রুসো গোল করে আর্সেনালের লিড আরও বাড়ান। এরপর ক্যাটলিন ফোর্ড লিয়ঁর রক্ষণভাগের একটি বিপর্যয়কর ভুলের সুযোগ নিয়ে চতুর্থ গোলটি করেন। লিয়ঁর মেলচি ডুমর্নে, যিনি প্রথম লেগে জয়সূচক গোল করেছিলেন, একটি গোল ফিরিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর্সেনাল ৫-৩ এগ্রিগেট স্কোরে জয় তুলে নিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায়।
ইংলিশ উইমেন্স সুপার লিগে চেলসির পিছনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা আর্সেনাল এখন ২৪ মে লিসবনে বার্সেলোনার মুখোমুখি হবে। বার্সেলোনা একই দিনে চেলসির বিপক্ষে ৪-১ গোলে জয় তুলে ৮-২ এগ্রিগেটে ফাইনালে উঠেছে। টানা তৃতীয়বার এবং সামগ্রিকভাবে চতুর্থবার শিরোপা জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া বার্সেলোনা ফাইনালে ফেভারিট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
১৮ বছর পর প্রথম ফাইনাল
আর্সেনাল ২০০৭ সালে, যখন এই প্রতিযোগিতার নাম ছিল ইউয়েফা উইমেন্স কাপ, তখন শিরোপা জিতেছিল। এরপর এটি তাদের প্রথম ফাইনালে উঠা। এই অর্জন অসাধারণ, কারণ লিয়ঁ এই মরসুমে দ্বিতীয় লেগের আগে প্রতিযোগিতার সব ম্যাচে জয়ী হয়েছিল এবং গত ১০ বছরে তাদের অষ্টম ফাইনালে খেলার লক্ষ্যে এগোচ্ছিল।
লিয়ঁ নিজেদের মাঠ গ্রুপামা স্টেডিয়ামে সমর্থকদের সামনে প্রথম লেগের ২-১ গোলের লিড নিয়ে ম্যাচে নামে। তবে স্টেডিয়ামটি পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি। লিয়ঁর অধিনায়ক ওয়েন্ডি রেনার্ড চোট কাটিয়ে ফিরে এসে কেন্দ্রীয় রক্ষণে খেলেন। এটি ছিল তাঁর ক্লাবের হয়ে ৫০০তম ম্যাচ। কিন্তু লিয়ঁ ম্যাচের শুরুতেই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে এবং পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে লিয়ঁ পিছিয়ে পড়ে। আর্সেনালের একটি কর্নারে লিয়ঁর ডামারিস এগুরোলা নিজেদের ছয় গজের বক্সে বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে গোলকিপার এন্ডলারের গায়ে বল লাগিয়ে ফেলেন, যা আত্মঘাতী গোল হিসেবে গণ্য হয়। এই গোল আর্সেনালকে দিনের খেলায় এগিয়ে দেয়।
প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে ক্যালডেনটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় গোলটি করেন। সাবেক বার্সেলোনা এই খেলোয়াড় রুসোর লে-অফ থেকে বল নিয়ে বক্সের বাইরে থেকে উঁচু শটে গোল করেন। এই গোলের মাধ্যমে আর্সেনাল এগ্রিগেট স্কোরে এগিয়ে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আর্সেনাল তাদের আধিপত্য আরও জোরালো করে। ইংল্যান্ডের তারকা রুসো কিক-অফের পরপরই এককভাবে গোল করে আর্সেনালকে আরও এগিয়ে দেন। ৬৩তম মিনিটে লিয়ঁর রক্ষণভাগের আরেকটি ভুলের সুযোগ নেন অস্ট্রেলিয়ার তারকা ফোর্ড। লিয়ঁর ভানেসা গিলস এন্ডলারের একটি ছোট পাস নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পিছলে পড়েন, আর ফোর্ড এগিয়ে গিয়ে গোলকিপারকে পরাস্ত করেন।
ম্যাচের শেষ ১০ মিনিটে ডুমর্নে একটি গোল ফিরিয়ে দেন, কিন্তু লিয়ঁর জন্য তখন আর সমতায় ফেরার সময় ছিল না। আর্সেনাল শেষ পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে টিকে থেকে ৫-৩ এগ্রিগেটে জয় নিশ্চিত করে।
আর্সেনালের অসাধারণ যাত্রা
আর্সেনালের এই জয় তাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ২০০৭ সালের পর এটি তাদের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। লিয়ঁর মতো একটি দল, যারা ইউরোপীয় ফুটবলে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে, তাদের বিপক্ষে এই জয় আর্সেনালের শক্তি এবং কৌশলগত দক্ষতার প্রমাণ। ম্যাচের শুরু থেকেই আর্সেনালের খেলোয়াড়রা আক্রমণাত্মক এবং সংঘবদ্ধ ফুটবল খেলেছে। ক্যালডেনটির গোল, রুসোর দ্রুত প্রতিক্রিয়া, এবং ফোর্ডের সুযোগ গ্রহণের ক্ষমতা আর্সেনালের এই জয়ের মূল চাবিকাঠি ছিল।
অন্যদিকে, লিয়ঁর জন্য এই হার একটি বড় ধাক্কা। আটবারের চ্যাম্পিয়ন এই দলটি এই মরসুমে অপরাজিত ছিল এবং নিজেদের মাঠে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তাদের রক্ষণভাগের ভুল এবং আর্সেনালের আক্রমণাত্মক ফুটবল তাদের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়। রেনার্ডের ফিরে আসা সত্ত্বেও লিয়ঁ তাদের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়নি।
ফাইনালের পথে বার্সেলোনার চ্যালেঞ্জ
আর্সেনাল এখন ফাইনালে বার্সেলোনার মুখোমুখি হবে, যারা ইউরোপীয় নারী ফুটবলে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে। বার্সেলোনা তাদের শক্তিশালী স্কোয়াড এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের জন্য ফেভারিট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে আর্সেনাল, যারা লিয়ঁর মতো একটি দলকে হারিয়েছে, ফাইনালে অঘটন ঘটানোর ক্ষমতা রাখে।
ক্যালডেনটি, যিনি সাবেক বার্সেলোনা খেলোয়াড়, তাঁর প্রাক্তন দলের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে অতিরিক্ত প্রেরণা পেতে পারেন। রুসো এবং ফোর্ডের মতো খেলোয়াড়রাও তাদের ফর্ম ধরে রাখলে আর্সেনাল বার্সেলোনার জন্য একটি শক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
ইংলিশ উইমেন্স সুপার লিগে আর্সেনালের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাদের এই সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। চেলসির পিছনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই দলটি ঘরোয়া এবং ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সমানতালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তাদের কোচ এবং খেলোয়াড়দের সমন্বিত প্রচেষ্টা এই মরসুমে তাদের একটি শক্তিশালী ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উইমেন্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে আর্সেনালের এই যাত্রা কেবল তাদের সমর্থকদের জন্যই নয়, বরং ইংলিশ নারী ফুটবলের জন্যও একটি গর্বের মুহূর্ত। ১৮ বছর পর ফাইনালে ফিরে আসা আর্সেনাল এখন তাদের দ্বিতীয় ইউরোপীয় শিরোপার স্বপ্ন দেখছে। লিসবনে বার্সেলোনার বিপক্ষে তাদের লড়াই নারী ফুটবলের একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায় হতে চলেছে।