পর্যটকদের প্রত্যাবর্তন! আশা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্বাভাবিকতার পথে পহেলগাঁও?

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে (Pahalgam) গত ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মাত্র পাঁচ দিন পর, এই নির্মল শহরে আশা ও আত্মবিশ্বাসের এক নতুন ঢেউ দেখা…

Tourists Return to Pahalgam

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে (Pahalgam) গত ২২ এপ্রিলের ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মাত্র পাঁচ দিন পর, এই নির্মল শহরে আশা ও আত্মবিশ্বাসের এক নতুন ঢেউ দেখা দিয়েছে। যে শহরটি প্রতিদিন ৫,০০০ থেকে ৭,০০০ পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকত, হামলার পর তা মাত্র ৫০-১০০ জন পর্যটকের উপস্থিতিতে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজ, পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় এক হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ফুটে উঠেছে—দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আবারও এই শহরের রাস্তায় বিচরণ করছেন, স্বাভাবিকতা ও আশার বার্তা নিয়ে। ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়ার পর্যটকরা নির্ভয়ে পহেলগাঁওয়ের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কাশ্মীরের অতুলনীয় সৌন্দর্য ও এখানকার মানুষের আন্তরিকতার প্রশংসা করছেন।

   

বিদেশি পর্যটকদের অভিজ্ঞতা

ক্রোয়েশিয়ার পর্যটক লিলিয়ানা এএনআই-কে বলেন, “আমরা ক্রোয়েশিয়া থেকে এসেছি এবং এখানে তিন-চার দিন ধরে আছি। আমরা পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করছি, এবং আপনাদের দেশ খুবই সুন্দর। এখানে থাকতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কাশ্মীর অপূর্ব, অত্যন্ত সুন্দর। আপনাদের দেশ অনন্য। আমরা আপনাদের প্রকৃতি ও মানুষের আন্তরিকতায় খুবই সন্তুষ্ট। আমাদের ১২ জনের দলে দুজন সার্বিয়া থেকে এবং বাকিরা ক্রোয়েশিয়া থেকে। আমরা এখানে খুব খুশি।” হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা ঘটনার কথা একদিন আগে শুনেছিলাম। তবু আমরা কাশ্মীরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা এখানে নিরাপদ বোধ করছি, কোনো সমস্যা হয়নি। যা ঘটেছে তা ভয়াবহ। যারা এর জন্য দায়ী, তারা যেন এই বার্তা শোনে—আমি আশা করি এটি আপনাদের দেশে এবং সারা বিশ্বে বন্ধ হবে।”

অন্য একজন ক্রোয়েশিয়ান পর্যটক ভ্লাটকো বলেন, “এটি আমার কাশ্মীরে দশম সফর, এবং প্রতিবারই এটি অসাধারণ। আমার কাছে কাশ্মীর বিশ্বের সেরা। এখানকার প্রকৃতি এবং মানুষের সৌম্যতা অতুলনীয়। আমার দলের জন্য এটি প্রথম সফর, এবং তারা ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়া থেকে এসে খুব খুশি।” নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করি, কোনো সমস্যা নেই। সবাই হ্যালো বলে, আমি একটুও ভয় পাইনি।”

ক্রোয়েশিয়ার আরেক পর্যটক আদমির জাহিচ বলেন, “কাশ্মীরে আমি অসাধারণ বোধ করছি। এখানে আমি অনেক বন্ধু তৈরি করেছি, মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ। এমন মানুষদের সঙ্গে দেখা করে আমি সত্যিই খুব খুশি।” হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “এমন খবর শোনা সহজ নয়, বিশেষ করে মিডিয়া যেভাবে এটি প্রচার করে। আমি নিজে কোনো ভয় অনুভব করিনি। আমি জানি এটি এখানে নিয়মিত ঘটে না, এটি যে কোনো জায়গায় ঘটতে পারে। ভয় পেলে আপনি বাড়িতে থাকতে পারেন, কিন্তু সেখানেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এটি ইউরোপে ঘটে, সব জায়গায় ঘটে। বিশ্বে এখন আর নিরাপদ জায়গা নেই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি আমাকে ভ্রমণ ও মানুষের সঙ্গে দেখা করা থেকে বিরত করে না। যা ঘটেছে তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত, কারণ এখানকার মানুষ ও দেশ অসাধারণ। তারা শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রাপ্য, ভয় নয়। এটি সবাইকে কষ্ট দেয়।”

সার্বিয়ার ইভানা কাশ্মীরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা এখন আপনাদের এই সুন্দর উপত্যকা ও দেশের প্রকৃতি আরও দেখতে যাচ্ছি। আমাদের এখানে আতিথ্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমরা ঘটনার কথা আমাদের দেশ ছাড়ার আগে শুনেছিলাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি আমাদের বছরের পর বছর পরিকল্পনা করা একটি সফর। আমরা জানতাম এই দেশ সুন্দর, এবং আমরা শুধু ভালো জিনিসই আশা করেছিলাম। ধন্যবাদ, কাশ্মীর।”

ভারতীয় পর্যটকদের দৃষ্টিভঙ্গি

গুজরাটের সুরাটের মোহাম্মদ আনাস ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন, “আমরা কাশ্মীরে সত্যিই খুব উপভোগ করছি। এখন আমরা পহেলগাঁওয়ে আছি। আমাদের পর্যটক ভাইদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এটি আমাদের জন্য একটি বড় ক্ষতি। তবে, পহেলগাঁওয়ে বাজার ও সবকিছু এখনও খোলা আছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে আছে, সরকার আমাদের সঙ্গে আছে, এবং স্থানীয় মানুষও আমাদের সমর্থন করছে। আমি যখন থেকে এসেছি, আমি একটুও ভয় পাইনি।” তিনি আরও বলেন, “আমরা যখন পথে ছিলাম এবং ঘটনার কথা শুনেছিলাম, তখন আমরা বেশ ভয় পেয়েছিলাম এবং ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু স্থানীয় মানুষ ও সেনাবাহিনী আমাদের অনেক সমর্থন করেছে এবং আশ্বাস দিয়েছে যে এখানে কোনো সমস্যা নেই। তারা আমাদের পহেলগাঁও দেখতে উৎসাহিত করেছে। যা ঘটেছে তা ভয়াবহ, এবং যারা এটি করেছে তারা খুব ভুল করেছে; এটি কখনোই ঘটা উচিত ছিল না।”

স্থানীয় মানুষের সংহতি ও প্রতিবাদ

আজ পহেলগাঁওয়ের মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সাহসের এক অসাধারণ প্রকাশ দেখা গেছে। স্থানীয়রা জাতীয় পতাকা হাতে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছেন, “দেশ কে গদ্দারো কো, গোলি মারো” স্লোগানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই প্রতিবাদ কাশ্মীরের মানুষের অদম্য মনোভাব এবং শান্তির প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রতীক।

পহেলগাঁওয়ের পর্যটন ও অর্থনীতি

পহেলগাঁও, যাকে প্রায়ই ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ বলা হয়, তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। বাইসারান মেডোর মতো স্থানগুলি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০২৪ সালে কাশ্মীরে প্রায় ৩৫ লক্ষ পর্যটক এসেছিলেন, যা এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পের উন্নতির ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু হামলার পর পর্যটন শিল্পে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছিল। ফ্লাইট বাতিলের হার সাত গুণ বেড়ে গিয়েছিল, এবং ভবিষ্যৎ বুকিং ৪০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। তবে, পর্যটকদের প্রত্যাবর্তন এবং স্থানীয়দের সমর্থন এই শিল্পের পুনরুদ্ধারের আশা জাগিয়েছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সরকারি পদক্ষেপ

হামলার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ফোর্স এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ যৌথভাবে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। পহেলগাঁওয়ে অস্থায়ী লকডাউন জারি করা হয়েছিল, এবং সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলি জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে নিয়োজিত ছিল। জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) তদন্তে সহায়তা করছে, এবং পুলিশ তিনজন সন্দেহভাজনের স্কেচ প্রকাশ করেছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা পর্যটকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে।

পহেলগাঁওয়ের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা কাশ্মীরের শান্তি ও পর্যটন শিল্পে একটি বড় আঘাত হলেও, পর্যটকদের প্রত্যাবর্তন এবং স্থানীয় মানুষের সংহতি এই অঞ্চলের অদম্য চেতনার প্রমাণ। ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকদের কণ্ঠে কাশ্মীরের সৌন্দর্য ও আতিথেয়তার প্রশংসা শোনা যাচ্ছে। স্থানীয়দের সমর্থন, সেনাবাহিনীর তৎপরতা এবং সরকারের প্রচেষ্টা পহেলগাঁওকে আবারও পর্যটকদের কাছে নিরাপদ ও আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। কাশ্মীরের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, এখানকার মানুষের উষ্ণতা এবং এর অদম্য চেতনা ধীরে ধীরে পর্যটকদের ফিরিয়ে আনছে, একটি নতুন স্বাভাবিকতার পথে।