গত তিন দিনে মোট ৫৩৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক আটারি সীমান্ত দিয়ে ভারত ত্যাগ করেছেন। রবিবার স্বল্পমেয়াদী ভিসাধারীদের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার পর এই তথ্য প্রকাশ করেছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। আটারি সীমান্তের প্রটোকল অফিসার অরুণ পাল এএনআই-কে জানিয়েছেন, গত তিন দিনে ৮৫০ জন ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তান থেকে ভারতে ফিরে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র রবিবারই ২৩৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক তাদের দেশে ফিরে গেছেন, এবং ১১৬ জন ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তান থেকে ফিরেছেন।
অরুণ পাল বলেন, “কাস্টমস ইমিগ্রেশন কাউন্টার সকাল ১০টায় খোলা হয়েছিল। কাউন্টার বন্ধ হওয়ার আগে ২৩৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক ভারত থেকে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন, এবং ১১৬ জন ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তান থেকে ফিরেছেন। ২৪ এপ্রিল থেকে মোট ৫৩৭ জন পাকিস্তানি নাগরিক পাকিস্তানে ফিরে গেছেন, এবং ৮৫০ জন ভারতীয় নাগরিক ভারতে ফিরেছেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি পাসপোর্টধারীদের ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্ত পার হওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় পাসপোর্টধারীদের জন্যও একই সময়সীমা প্রযোজ্য।”
ভারত সরকার শুক্রবার পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য জারি করা সমস্ত ধরনের ভিসা বাতিল করেছে, যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী, কূটনৈতিক এবং সরকারি ভিসা ছাড়া অন্য সব ভিসা রয়েছে। এই নির্দেশ ২৭ এপ্রিল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া হয়েছে।
২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক, এবং একজন নেপালি নাগরিকও এতে প্রাণ হারান। এই ঘটনা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর এই অঞ্চলের সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪০ জন জওয়ান শহিদ হয়েছিলেন।
হামলার পর জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) ২৩ এপ্রিল থেকে পহেলগাঁওয়ে ঘটনাস্থলে তদন্ত শুরু করেছে। এনআইএ-এর একজন আইজি, ডিআইজি এবং এসপি-এর নেতৃত্বে দলটি প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে এবং প্রমাণ সংগ্রহের কাজ তীব্র করেছে। এছাড়া, ভারতীয় সেনাবাহিনী উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং পহেলগাঁওয়ে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের নিষ্ক্রিয় করতে বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান অভিযান চালাচ্ছে।
এই ঘটনা সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, এবং জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। পহেলগাঁও হামলাকে পাকিস্তান-সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের কাজ বলে মনে করা হচ্ছে, যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও তিক্ত করেছে।
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত সরকার বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র পথচারী সীমান্ত ক্রসিং, তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সার্ক ভিসা ছাড় স্কিমের অধীনে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এবং এই স্কিমের অধীনে ইতিমধ্যে জারি করা সমস্ত ভিসা বাতিল করা হয়েছে। পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
চিকিৎসা ভিসাধারীদের জন্য সময়সীমা ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, তবে অন্য সব স্বল্পমেয়াদী ভিসাধারীদের জন্য সময়সীমা ২৭ এপ্রিল শেষ হয়েছে। যারা এই সময়সীমার পরে ভারতে থেকে যাবেন, তাদের বিরুদ্ধে নতুন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাক্ট, ২০২৫-এর অধীনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
আটারি সীমান্তে ফিরে যাওয়া অনেক পাকিস্তানি নাগরিক হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একটি পরিবার, যারা ভারতে আত্মীয়ের বিয়েতে অংশ নিতে এসেছিল, বলেছে, “আমরা ১০ এপ্রিল ৪৫ দিনের ভিসা নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু মাত্র ১৫ দিন পরেই ফিরে যেতে হচ্ছে। পুলিশ আমাদের তাড়াতাড়ি ভারত ছাড়তে বলেছে। এটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।”
অন্য একজন পাকিস্তানি নাগরিক, শেখ ফজল আহমদ, বলেন, “যিনি এই হামলা করেছেন, তিনি সম্পূর্ণ ভুল করেছেন। আমরা দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব চাই। ঘৃণার কোনো জায়গা থাকা উচিত নয়।”
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ইন্দু জল চুক্তি, যা ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা পাকিস্তান সীমান্ত পার সন্ত্রাসবাদের সমর্থন বন্ধ না করা পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া, পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত প্রতিরক্ষা, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর উপদেষ্টাদের পার্সোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করা হয়েছে এবং তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভারত তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাদের ইসলামাবাদ থেকে প্রত্যাহার করছে এবং দুই দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে। এই পদক্ষেপগুলি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত দেয়।
এক্স-এ পোস্টগুলিতে দেখা গেছে, ভারতীয় নাগরিকরা পহেলগাঁও হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন এবং সরকারের কঠোর পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পাকিস্তানকে এবার উপযুক্ত জবাব দেওয়া দরকার। আটারি সীমান্ত বন্ধ এবং ভিসা বাতিল সঠিক পদক্ষেপ।” তবে, কিছু পাকিস্তানি নাগরিক দাবি করেছেন যে সাধারণ মানুষকে এই সিদ্ধান্তের জন্য শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়।
পহেলগাঁও হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। ৫৩৭ জন পাকিস্তানি নাগরিকের আটারি সীমান্ত দিয়ে প্রত্যাবর্তন এবং ৮৫০ জন ভারতীয় নাগরিকের ফিরে আসা এই উত্তেজনার প্রতিফলন। ভারত সরকারের কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যার মধ্যে ভিসা বাতিল, সীমান্ত বন্ধ এবং ইন্দু জল চুক্তি স্থগিত রয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে। তবে, এই পদক্ষেপগুলি দুই দেশের মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি কীভাবে বিবর্তিত হয়, তা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করবে।