ভারতীয় নৌবাহিনী (Indian Navy) সম্প্রতি আরব সাগরে একাধিক সফল অ্যান্টি-শিপ মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে, যা দেশের সমুদ্র নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্র সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ জানিয়েছেন, এই পরীক্ষাগুলি দীর্ঘ পরিসরের নির্ভুল আক্রমণের জন্য প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম এবং ক্রুদের কার্যকারিতা পুনরায় যাচাই এবং প্রদর্শনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। এই মহড়ার মাধ্যমে নৌবাহিনী ভারতের সমুদ্র স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তার যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে।
নৌবাহিনীর এক্স পোস্টে বলা হয়েছে, “ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলি দীর্ঘ পরিসরের নির্ভুল আক্রমণের জন্য প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম এবং ক্রুদের প্রস্তুতি পুনরায় যাচাই এবং প্রদর্শনের জন্য একাধিক সফল অ্যান্টি-শিপ মিসাইল পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী জাতির সমুদ্র স্বার্থ রক্ষায় যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধ প্রস্তুত, বিশ্বাসযোগ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রস্তুত।”
এই পরীক্ষাগুলি জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে ২২ এপ্রিল সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত হয়েছে, যেখানে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এই হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর আরব সাগরে নির্ধারিত সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল পরীক্ষার আগেই ভারতীয় নৌবাহিনী এই পরীক্ষাগুলি সম্পন্ন করেছে, যা ভারতের কৌশলগত প্রতিক্রিয়ার একটি ইঙ্গিত।
আইএনএস সুরতের পূর্ববর্তী সাফল্য
এর আগে, ভারতীয় নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার আইএনএস সুরত আরব সাগরে মাঝারি পরিসরের সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এমআর-এসএএম) পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল। এই মিসাইল সিস্টেম, যা ইসরায়েলের সহযোগিতায় তৈরি, ৭০ কিলোমিটার পরিসরে সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল এবং অন্যান্য বায়বীয় হুমকি মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর। এই পরীক্ষাটি সমুদ্র-স্কিমিং টার্গেটের বিরুদ্ধে নির্ভুল সমন্বিত আক্রমণের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল, যা ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
নৌবাহিনী এক্স-এ লিখেছে, “ভারতীয় নৌবাহিনীর সর্বশেষ দেশীয় গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার আইএনএস সুরত একটি সমুদ্র-স্কিমিং টার্গেটের বিরুদ্ধে নির্ভুল সমন্বিত আক্রমণ সফলভাবে পরিচালনা করেছে, যা আমাদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা জোরদার করার ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক। এটি আত্মনির্ভর ভারতের জন্য গর্বের মুহূর্ত!”
আইএনএস সুরত: আত্মনির্ভর ভারতের প্রতীক
আইএনএস সুরত পি১৫বি গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার প্রকল্পের চতুর্থ এবং চূড়ান্ত জাহাজ, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং অত্যাধুনিক ডেস্ট্রয়ারগুলির মধ্যে একটি। এই জাহাজটি ৭৫ শতাংশ দেশীয় উপাদান দিয়ে নির্মিত, যা ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদনে আত্মনির্ভরতার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। এটি ব্রহ্মোস এবং বারাক-৮ মিসাইল, অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সমন্বিত নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক ক্ষমতা দিয়ে সজ্জিত। জানুয়ারি ২০২৫-এ কমিশন করা এই জাহাজটি ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং দেশীয় নকশা ও উন্নয়নের ক্ষমতার প্রমাণ।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপট
পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই হামলার সঙ্গে সীমান্তের ওপারের সংযোগ নিশ্চিত হওয়ায় ভারত সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নৌবাহিনীর মিসাইল পরীক্ষা কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নয়, বরং কৌশলগত প্রতিক্রিয়ার একটি শক্তিশালী বার্তা।
আত্মনির্ভর ভারতের দিকে অগ্রগতি
এই পরীক্ষাগুলি ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার প্রতি অঙ্গীকারকে আরও জোরদার করেছে। অ্যান্টি-শিপ মিসাইল এবং এমআর-এসএএম-এর সফল পরীক্ষা ভারতীয় নৌবাহিনীর দীর্ঘ পরিসরের নির্ভুল আক্রমণ এবং বায়বীয় হুমকি মোকাবিলার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। এই অর্জনগুলি ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) এবং দেশীয় শিল্পের সঙ্গে সহযোগিতার ফল। আইএনএস সুরতের মতো জাহাজ এবং অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম ভারতের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে দেশীয় প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিফলিত করে।
অন্যান্য সাম্প্রতিক কার্যক্রম
অ্যান্টি-শিপ মিসাইল পরীক্ষার পাশাপাশি, ভারতীয় নৌবাহিনী সম্প্রতি তানজানিয়ার সঙ্গে প্রথম আইকেইমই নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। এই মহড়ায় আইএনএস চেন্নাই এবং আইএনএস কেসরি অংশগ্রহণ করেছিল, যা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এই ধরনের কার্যক্রম ভারতের সমুদ্র নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর সাম্প্রতিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল পরীক্ষা এবং আইএনএস সুরতের এমআর-এসএএম পরীক্ষা দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা এবং আত্মনির্ভরতার একটি শক্তিশালী প্রমাণ। পাহালগাম হামলার পর উত্তেজনার মধ্যে এই পরীক্ষাগুলি ভারতের কঠোর অবস্থান এবং সমুদ্র স্বার্থ রক্ষার দৃঢ়তা প্রকাশ করে। আইএনএস সুরতের মতো অত্যাধুনিক জাহাজ এবং দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ভারতীয় নৌবাহিনীকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নৌশক্তির মধ্যে নিয়ে এসেছে। এই অর্জনগুলি কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি ভারতের অটল প্রতিশ্রুতিও প্রতিফলিত করে।