বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে কর্মসংস্থানের (Employment in India) ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে দেশে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে। এই বৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মশক্তিতে মহিলাদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “২০২১-২২ থেকে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যাকে অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে, এবং শহরাঞ্চলে বেকারত্ব ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৬.৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৭-১৮ সালের পর সর্বনিম্ন।”
শহরাঞ্চলে বেকারত্ব হ্রাস ও শ্রমিকদের গতিশীলতা
রিপোর্টে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) শহরাঞ্চলের বেকারত্বের হার ৬.৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৭-১৮ সালের পর সর্বনিম্ন স্তর। এছাড়া, শ্রমিকদের গতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৮-১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো পুরুষ শ্রমিকরা গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের সন্ধানে বেশি সংখ্যায় স্থানান্তরিত হচ্ছেন। একই সঙ্গে, গ্রামীণ এলাকায় মহিলারা ক্রমশ কৃষি কাজে যুক্ত হচ্ছেন, যা দেশজুড়ে কর্মসংস্থানের ধরনে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
চ্যালেঞ্জ: যুব বেকারত্ব ও আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ঘাটতি
যদিও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ বজায় রয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যুব বেকারত্বের হার ১৩.৩ শতাংশ, এবং উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন যুবকদের মধ্যে এই হার আরও বেশি—২৯ শতাংশ। এটি দক্ষতার অমিল এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবের ইঙ্গিত দেয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “কৃষিবহির্ভূত বেতনভিত্তিক চাকরির মাত্র ২৩ শতাংশ আনুষ্ঠানিক, এবং কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক।” এছাড়া, গ্রামীণ শ্রমিক এবং মহিলাদের মধ্যে স্ব-কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে অনেকে নিয়মিত চাকরির পরিবর্তে নিজের জন্য কাজ করতে পছন্দ করছেন।
মহিলাদের কর্মসংস্থান ও লিঙ্গ বৈষম্য
মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার ৩১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, লিঙ্গ বৈষম্য এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেতনভিত্তিক চাকরিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলার সংখ্যা ২৩৪ মিলিয়ন কম। “৩১ শতাংশ মহিলা কর্মসংস্থানের হার সত্ত্বেও, লিঙ্গ বৈষম্য বজায় রয়েছে, যেখানে পুরুষদের তুলনায় ২৩৪ মিলিয়ন কম মহিলা বেতনভিত্তিক চাকরিতে নিয়োজিত,” বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছে। এই বৈষম্য কমাতে নীতিগত উদ্যোগ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রয়োজন।
দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি
দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রেও ভারত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে ভারতের অতি দরিদ্র জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ ছিল পাঁচটি জনবহুল রাজ্যে—উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্য প্রদেশ। এই রাজ্যগুলি সময়ের সঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাসে অবদান রেখেছে, তবে ২০২২-২৩ সালে এই রাজ্যগুলিতে এখনও দেশের ৫৪ শতাংশ অতি দরিদ্র এবং ৫১ শতাংশ বহুমাত্রিক দরিদ্র জনসংখ্যা বাস করে। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ১৭১ মিলিয়ন মানুষ অতি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে, এবং ৩৭৮ মিলিয়ন মানুষ বিস্তৃত দারিদ্র্য রেখার উপরে উঠে এসেছে।
অতি দারিদ্র্য ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য
বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, অতি দারিদ্র্য (প্রতিদিন ২.১৫ মার্কিন ডলারের কম আয়) ২০১১-১২ সালে ১৬.২ শতাংশ থেকে ২০২২-২৩ সালে ২.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্রামীণ অতি দারিদ্র্য ১৮.৪ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে এবং শহরাঞ্চলে ১০.৭ শতাংশ থেকে ১.১ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (MPI), যা অ-আর্থিক দারিদ্র্য পরিমাপ করে, ২০০৫-০৬ সালে ৫৩.৮ শতাংশ থেকে ২০১৯-২১ সালে ১৬.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের দারিদ্র্যের ব্যবধানও কমেছে, যা অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির দিকে অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়।
আয় বৈষম্যে উন্নতি
রিপোর্টে ভারতের আয় বৈষম্যের উন্নতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। খরচ-ভিত্তিক গিনি সূচক ২০১১-১২ সালে ২৮.৮ থেকে ২০২২-২৩ সালে ২৫.৫-এ নেমে এসেছে, যা আয় বৈষম্য হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। তবে, তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে বৈষম্যের পরিমাণ কিছুটা কম মূল্যায়িত হতে পারে। বিশ্ব অসমতা ডাটাবেসের মতে, আয়-ভিত্তিক গিনি সূচক ২০০৪ সালে ৫২ থেকে ২০২৩ সালে ৬২-এ উন্নীত হয়েছে, যা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈষম্যের বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত পথ
কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাস সত্ত্বেও, যুব বেকারত্ব, আনুষ্ঠানিক চাকরির অভাব, এবং লিঙ্গ বৈষম্য ভারতের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। শিক্ষিত যুবকদের জন্য উপযুক্ত চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, মহিলাদের কর্মশক্তিতে আরও অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা, এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রসার ভবিষ্যতের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং মধ্য প্রদেশের মতো রাজ্যগুলির উপর বিশেষ ফোকাস থাকা প্রয়োজন, কারণ এই রাজ্যগুলি দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্বব্যাঙ্কের এই রিপোর্ট ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছে। কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি, মহিলাদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, এবং দারিদ্র্য হ্রাস ভারতের সমৃদ্ধির পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, যুব বেকারত্ব এবং লিঙ্গ বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে নীতিগত উদ্যোগ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রয়োজন। ভারতের এই অগ্রগতি বিশ্ব মঞ্চে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি ও সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করছে।