জম্মু ও কাশ্মীরে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার (Pahalgam Terror Attack) পর নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তীব্র অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষ নিহত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ জঙ্গি অবকাঠামো ধ্বংস করার লক্ষ্যে আরেক সন্দেহভাজন জঙ্গির বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ফারুক আহমদ তড়ওয়ার বাড়ি, যা উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার কালারুস এলাকায় অবস্থিত, নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় ছয়জন জঙ্গি বা তাদের সহযোগীর বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, এবং কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও এই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তীব্র অভিযান ও অস্ত্র-নথি জব্দ
শনিবার শ্রীনগরে ৬০টিরও বেশি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই অভিযানে অস্ত্র, নথি, ডিজিটাল ডিভাইস ইত্যাদি জব্দ করা হয়েছে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল প্রমাণ সংগ্রহ এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা জঙ্গি কার্যকলাপ শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা। পুলিশের মুখপাত্র আরও বলেন, “জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের এই দৃঢ় পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো জঙ্গি ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা এবং এই ধরনের জাতিবিরোধী ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”
তিনি জানান, পুলিশ শহরে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। “যে কোনো ব্যক্তি যিনি সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা বা অবৈধ কার্যকলাপের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তিনি আইনের অধীনে কঠোর আইনি পরিণতির মুখোমুখি হবেন,” বলে সতর্ক করেছেন তিনি। নিরাপত্তা বাহিনী উপত্যকার সর্বত্র জঙ্গি সহযোগী এবং তাদের সমর্থকদের ধরতে তৎপর, যাতে পহেলগাঁও-এর মতো হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।
পহেলগাঁও হামলা ও ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা
গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল ২০২৫) আনন্তনাগ জেলার পহেলগাঁও-এর উচ্চভূমিতে অবস্থিত বাইসারান মেডোতে, যা ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত এবং পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়, জঙ্গিরা গুলি চালায়। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত পর্যটক। এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, “যারা এই হামলার জন্য দায়ী, তাদের পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে।”
লস্কর-ই-তৈবার সহযোগী সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি লস্কর-ই-তৈবার শীর্ষ কমান্ডার সাইফুল্লাহ কাসুরি ওরফে খালিদকে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দুস জল চুক্তি স্থগিত করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করা এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করা।
ধ্বংস করা বাড়িগুলো
নিরাপত্তা বাহিনী বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে আনন্তনাগ জেলার বিজবেহারা এলাকায় লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গি আদিল হুসেন থোকার এবং পুলওয়ামা জেলার ত্রাল এলাকায় আসিফ শেখের বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। থোকার পহেলগাঁও হামলায় জড়িত তিনজন জঙ্গির একজন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এবং শেখের জড়িত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। আদিল থোকার ২০১৮ সালে পাকিস্তানে গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এবং গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরে ফিরে আসে।
শুক্রবার রাতে পুলওয়ামা, শোপিয়ান, কুপওয়ারা এবং কুলগাম জেলায় আরও চারটি সন্দেহভাজন জঙ্গির বাড়ি ধ্বংস করা হয়। শোপিয়ানের চোটিপোরা গ্রামে লস্কর-ই-তৈবার কমান্ডার শাহিদ আহমেদ কুত্তের বাড়ি ধ্বংস করা হয়, যিনি গত তিন-চার বছর ধরে জঙ্গি কার্যকলাপে সক্রিয়। কুলগামের মুতালহামা গ্রামে জাকির আহমেদ গানির বাড়িও ধ্বংস করা হয়, যিনি ২০২৩ সাল থেকে জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত।
জঙ্গি সহযোগীদের গ্রেপ্তার
নিরাপত্তা বাহিনী দক্ষিণ কাশ্মীরের চারটি জেলায় শতাধিক ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার (ওজিডব্লিউ) এবং তাদের সমর্থকদের গ্রেপ্তার করেছে। আনন্তনাগ পুলিশ তিনজন জঙ্গি—আদিল হুসেন থোকার, হাশিম মুসা ওরফে সুলেমান এবং আলি ভাই ওরফে তালহা ভাই—এর স্কেচ প্রকাশ করেছে এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য ২০ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। হাশিম এবং আলি পাকিস্তানি নাগরিক বলে জানা গেছে।
জনরোষ ও সংহতি
পহেলগাঁও হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা গেছে। শ্রীনগর, পুলওয়ামা, শোপিয়ান, আনন্তনাগ, বারামুল্লা এবং অন্যান্য শহরে মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় বিক্ষোভকারীরা হামলার নিন্দা জানিয়ে কাশ্মীরিয়তের উপর আঘাত হিসেবে এটিকে বর্ণনা করেছে। শ্রীনগরের জামিয়া মসজিদে মিরওয়াজ উমর ফারুক বলেন, “কাশ্মীরিরা ভুক্তভোগীদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে।”
ভারতজুড়ে প্রতিবাদ ও মোমবাতি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেভান্থ রেড্ডি এবং এআইএমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি হায়দ্রাবাদে মোমবাতি মিছিলে অংশ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, কংগ্রেস নেতা রাষ্ট্রপতি মুর্মু, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সহ বিশ্ব নেতারা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
পহেলগাঁও হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর তীব্র অভিযান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের শূন্য-সহনশীলতা নীতির প্রতিফলন। জঙ্গিদের বাড়ি ধ্বংস, অভিযান এবং গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভাঙার চেষ্টা করছে। এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও জটিল করেছে, এবং ভারত জঙ্গিদের নির্মূল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।