ভারত ২০২৫ সালে জাপানকে অতিক্রম করে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির স্থান দখল করতে প্রস্তুত এবং ২০২৮ সালের মধ্যে জার্মানিকে ছাড়িয়ে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর সর্বশেষ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ভারত আগামী দুই বছর ধরে প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখবে।
IMF-এর এপ্রিল ২০২৫ সংস্করণের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) অনুসারে, ভারতের অর্থনীতি ২০২৫ সালে ৬.২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৬.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে, যা বিশ্বব্যাপী এবং আঞ্চলিক প্রতিযোগীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে থাকবে। তবে, জানুয়ারি ২০২৫-এর তুলনায় ২০২৫ সালের জন্য এই প্রক্ষেপণে ০.৩ শতাংশ পয়েন্ট নিম্নমুখী সংশোধন করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা এবং ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার প্রভাবকে প্রতিফলিত করে।
অন্যদিকে, IMF বিশ্ব অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অনেক কম হবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে, ২০২৫ সালে ২.৮ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ৩.০ শতাংশ। এই প্রক্ষেপণগুলি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির প্রতিফলন ঘটায়। ভারতের এই শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণ বিশ্ব মঞ্চে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং স্থিতিস্থাপকতার ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: একটি স্থিতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি:
IMF-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ৬.২ শতাংশে স্থিতিশীল থাকবে, যা মূলত গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তিগত খরচের দ্বারা সমর্থিত। ২০২৪-২৫ সালে ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় এটি কিছুটা কম, তবে এটি এখনও বিশ্বের অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি। ২০২৬-২৭ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই প্রক্ষেপণে নিম্নমুখী সংশোধন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তার প্রভাবের কারণে হয়েছে। তবুও, ভারতের অর্থনীতি তার স্থিতিস্থাপকতা এবং গতিশীলতার কারণে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখবে।
IMF উল্লেখ করেছে যে ভারতের প্রবৃদ্ধি গ্রামীণ খরচ, ক্রমবর্ধমান শিল্প উৎপাদন এবং সেবা খাতের শক্তিশালী প্রদর্শনের দ্বারা সমর্থিত। এছাড়া, ভারতের ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, যেমন মুদ্রাস্ফীতি ২০২৫-২৬ সালে ৪.২ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ সালে ৪.১ শতাংশে নেমে আসা, দেশের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শক্তিশালী করছে। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতের আমদানির উপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ বাড়তে পারে, যা ভারতের রপ্তানি-ভিত্তিক শিল্পগুলির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
জাপানের অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণ: শুল্ক যুদ্ধের প্রভাব:
IMF জাপানের ২০২৫ সালের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ জানুয়ারির ১.১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৬ শতাংশে নামিয়েছে। এই নিম্নমুখী সংশোধন মূলত মার্কিন শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে, যা জাপানের রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। জাপানের অর্থনীতি, যা ইতিমধ্যেই দুর্বল ইয়েন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার সীমাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করছে, এই শুল্ক যুদ্ধের ফলে আরও ধীরগতির সম্মুখীন হবে। ফলস্বরূপ, ভারতের নামমাত্র জিডিপি ২০২৫ সালে ৪.৩৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা জাপানের ৪.৩১ ট্রিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ: মার্কিন শুল্কের প্রভাব:
২০২৫ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধকে তীব্র করে তুলেছে। এই শুল্কগুলি কানাডা, চীন, মেক্সিকো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতকে লক্ষ্য করে আরোপ করা হয়েছিল, যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে পড়ে। তবে, এক সপ্তাহ পরে ট্রাম্প চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের জন্য ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করার ঘোষণা দেন, যখন চীনের উপর আরও কঠোর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যখন চীন আমেরিকান পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে পাল্টা জবাব দিয়েছে।
এই শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। IMF-এর প্রক্ষেপণ অনুসারে, মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ১.৮ শতাংশে নেমে আসবে, যা জানুয়ারির ২.৭ শতাংশ প্রক্ষেপণের তুলনায় ০.৯ শতাংশ পয়েন্ট কম। চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২০২৫ এবং ২০২৬ সালে ৪ শতাংশে নেমে আসবে, যা জানুয়ারির তুলনায় যথাক্রমে ০.৬ এবং ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট কম। বিশ্ব বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ১.৭ শতাংশে নেমে আসবে, যা জানুয়ারির প্রক্ষেপণের তুলনায় ১.৫ শতাংশ পয়েন্ট কম।
ভারতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ:
ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য উত্তেজনা সত্ত্বেও স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, মার্কিন শুল্ক এবং বিশ্ব অর্থনীতির ধীরগতি ভারতের রপ্তানি খাতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। IMF-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে-অলিভিয়ের গৌরিনচাস উল্লেখ করেছেন যে শুল্ক যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং বাণিজ্য বাধা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ভারতের জন্য, এই পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ উভয়ই নিয়ে আসে। ‘চীন + ১’ কৌশলের অংশ হিসেবে ভারত উৎপাদন এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ পেতে পারে। তবে, বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির ধীরগতি এবং শুল্কের প্রভাব ভারতের বাণিজ্য ভারসাম্যের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের নীতিগত সংস্কার, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার ভারতের প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
IMF-এর প্রক্ষেপণ ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার একটি উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরে, যেখানে দেশটি ২০২৫ সালে জাপানকে এবং ২০২৮ সালে জার্মানিকে ছাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিগুলির মধ্যে নিজের স্থান আরও সুসংহত করবে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ এবং শুল্কের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারতের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি এবং ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশটির অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রমাণ। সঠিক নীতি এবং কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্বের পথে আরও এগিয়ে যাবে।