জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং এর প্রোমোটার ও সহযোগী সংস্থাগুলির সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে, ভারতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন সংস্থা (IREDA) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) নির্দেশিকা এবং সংস্থার নিজস্ব যথাযথ পরিশ্রম প্রোটোকল অনুসারে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে।
IREDA জানিয়েছে যে জেনসোলের অ্যাকাউন্ট বর্তমানে চাপের মধ্যে রয়েছে, তবে এটি এখনও নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (এনপিএ) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ হয়নি। IREDA-র তদন্ত ও ঝুঁকি কমিটি এই বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করছে। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে জামানত এবং পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রোমোটারদের শেয়ার হ্রাস: চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ:
ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলির দ্বারা উত্থাপিত জাল নথির বিষয়ে, IREDA স্পষ্ট করেছে যে তারা এই নথিগুলি জারি করেনি। জেনসোলের প্রোমোটাররা ঋণদাতাদের অনুমোদন ছাড়াই তাদের শেয়ারহোল্ডিং হ্রাস করেছে, যা চুক্তি লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে, IREDA ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে জেনসোলের বিরুদ্ধে ইকোনমিক অফেন্সেস উইং (EoW)-এর কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেছে। IREDA জানিয়েছে যে তারা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তদন্ত শেষ হলে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের আপডেট করবে। সংস্থাটি তদন্ত চলাকালীন সকলকে জল্পনা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে।
জেনসোল তহবিল কেলেঙ্কারি: সেবির তদন্ত ও নিষেধাজ্ঞা:
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) সম্প্রতি জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে একটি আদেশ জারি করেছে, যা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ গুরুতর সমস্যাগুলিকে প্রকাশ করেছে। সেবি জেনসোলের প্রোমোটার ভাইদের, অন্মোল সিং জাগি এবং পুনিত সিং জাগিকে সিকিউরিটিজ মার্কেট থেকে নিষিদ্ধ করেছে।
তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক কোম্পানির তহবিল ব্যক্তিগত স্বার্থে অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ঋণ তহবিল সরিয়ে নেওয়া, বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা এবং নিয়ন্ত্রকদের বিভ্রান্ত করা। সেবির অন্তর্বর্তী আদেশে তাদের পুঁজি বাজারে প্রবেশ এবং যেকোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, IREDA এবং পাওয়ার ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (পিএফসি) থেকে জেনসোলের জন্য প্রাপ্ত ৯৭৮ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় ২৬২ কোটি টাকা অপব্যবহার করা হয়েছে। এই তহবিল ব্লুস্মার্টের জন্য ৬,৪০০টি বৈদ্যুতিক যান (ইভি) ক্রয়ের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেবির তদন্তে দেখা গেছে যে মাত্র ৪,৭০৪টি যান কেনা হয়েছে। বাকি তহবিলের একটি অংশ ব্যক্তিগত বিলাসিতার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চমানের রিয়েল এস্টেট, বিদেশ ভ্রমণ, গলফ সরঞ্জাম এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত খরচ।
জাল নথি ও ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির সঙ্গে বিভ্রান্তি:
সেবির তদন্তে আরও প্রকাশ পেয়েছে যে জেনসোল ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আইসিআরএ এবং কেয়ার-এর কাছে জাল নথি জমা দিয়েছিল। এই নথিগুলির মাধ্যমে দেখানো হয়েছিল যে জেনসোল IREDA এবং পিএফসি থেকে নেওয়া ঋণের পরিশোধ নিয়মিতভাবে করছে, যা সত্য ছিল না। আইআরইডিএ স্পষ্ট করেছে যে তারা এই ধরনের কোনো নথি জারি করেনি। এই জালিয়াতির কারণে মার্চ ২০২৫-এ আইসিআরএ এবং কেয়ার জেনসোলের ক্রেডিট রেটিংকে ‘ডি’ বা ‘ডিফল্ট’ স্থিতিতে নামিয়ে দেয়।
ব্লুস্মার্টের সঙ্গে সম্পর্ক ও আর্থিক চাপ:
জেনসোলের প্রোমোটাররা ব্লুস্মার্টেরও প্রোমোটার, যা একটি সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক রাইড-হেইলিং পরিষেবা। জেনসোলের ঋণের অর্থ ব্লুস্মার্টের জন্য ইভি ক্রয় এবং লিজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে ব্লুস্মার্টের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে লিজ পেমেন্ট বন্ধ হয়। এটি ঋণদাতাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে জেনসোলের ঋণ অ্যাকাউন্ট শীঘ্রই এনপিএ-তে পরিণত হতে পারে।
SEBI-র কঠোর পদক্ষেপ:
SEBI-র ১৫ এপ্রিলের অন্তর্বর্তী আদেশে বলা হয়েছে যে জেনসোলের প্রোমোটাররা কোম্পানির তহবিলকে ব্যক্তিগত ‘পিগি ব্যাঙ্ক’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তারা সম্পর্কিত পক্ষের মাধ্যমে তহবিল সরিয়েছেন এবং ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কহীন খরচের জন্য ব্যবহার করেছেন। এই তহবিল স্থানান্তরের ফলে কোম্পানির বই থেকে এই অর্থ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, যা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। সেবি জেনসোলের প্রস্তাবিত ১:১০ স্টক স্প্লিট বন্ধ করেছে এবং একটি ফরেনসিক অডিটের নির্দেশ দিয়েছে।
প্রোমোটারদের শেয়ার হ্রাস ও বাজারে প্রভাব:
জেনসোলের প্রোমোটারদের শেয়ারহোল্ডিং গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২০ সালে তাদের শেয়ার ৭০.৭২% থাকলেও, ২০২৫ সালে তা ৩৫%-এ নেমে এসেছে। বর্তমানে জাগি ভাইদের মালিকানা ৬২.৬৫%, যার মধ্যে ৮১.৬% শেয়ার বন্ধক রাখা হয়েছে। মার্চ ২০২৫ থেকে জেনসোলের শেয়ার মূল্য ৮০.৫% এবং বছরের শুরু থেকে ৮৭% হ্রাস পেয়েছে।
তদন্ত ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ:
IREDA এবং পিএফসি উভয়ই জেনসোলের ৬৬৩ কোটি টাকার ঋণের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তে ইভি ক্রয়ের জন্য বিতরণ করা তহবিলের ডেলিভারি রসিদের অভাব চিহ্নিত করা হচ্ছে। পিএফসি জানিয়েছে যে তারা ৩৫২ কোটি টাকা বিতরণ করেছে, যার মধ্যে ২,৭৪১টি যান সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জেনসোলের প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার বিরোধী আইনের অধীনে তদন্ত শুরু করতে পারে।
জেনসোল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে তহবিল অপব্যবহার এবং জাল নথি জমা দেওয়ার অভিযোগ ভারতের পরিচ্ছন্ন শক্তি খাতে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। আইআরইডিএ-র ইওডব্লিউ অভিযোগ এবং সেবির কঠোর পদক্ষেপ এই কেলেঙ্কারির গভীরতা প্রকাশ করেছে। তদন্তের ফলাফল জেনসোলের ভবিষ্যৎ এবং এর স্টেকহোল্ডারদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। এই ঘটনা ভারতের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং আর্থিক স্বচ্ছতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।