ক্রেডিট স্কোর (Credit Score) আজকের দিনে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঋণ গ্রহণ, ক্রেডিট কার্ডের আবেদন বা বাড়ি কেনার মতো বড় আর্থিক সিদ্ধান্তে ক্রেডিট স্কোরের প্রভাব অপরিসীম। তবে, এই ক্রেডিট স্কোর কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে ব্যাপক ভুল ধারণা এবং বিভ্রান্তি রয়েছে। এই ভুল ধারণার কারণে ঋণগ্রহীতারা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা তাঁদের ক্রেডিট স্কোরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সিআরআইএফ হাই মার্কের চেয়ারম্যান এবং সিআরআইএফ ইন্ডিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সচিন সেঠের মতে, এই ভুল ধারণাগুলো দূর করে ক্রেডিট স্কোরের প্রকৃত কারণগুলো বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রতিবেদনে আমরা ক্রেডিট স্কোর নিয়ে প্রচলিত কিছু মিথ্যা ধারণা ভেঙে দেব এবং এটি উন্নত করার মূল উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
ক্রেডিট স্কোর নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা:
ক্রেডিট স্কোর সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। এই ধারণাগুলো দূর করা আর্থিক সচেতনতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, কিছু প্রচলিত মিথ্যা ধারণা এবং এর পিছনের সত্যতা জেনে নিই:
১. মিথ্যা: নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করলে স্কোর কমে যায়:
সত্যতা: নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করা একটি “সফট ইনকোয়ারি” হিসেবে বিবেচিত হয়, যা ক্রেডিট স্কোরের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। নিয়মিত নিজের ক্রেডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করা আর্থিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য উপকারী।
২. মিথ্যা: আয় ক্রেডিট স্কোরের উপর প্রভাব ফেলে:
সত্যতা: ক্রেডিট স্কোর দায়িত্বশীল ক্রেডিট ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে, আয়ের উপর নয়। আপনি কীভাবে ক্রেডিট পরিচালনা করেন, তা স্কোর নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
৩. মিথ্যা: একাধিক ক্রেডিট অ্যাকাউন্টের জন্য আবেদন করলে স্কোর বাড়ে:
সত্যতা: স্বল্প সময়ের মধ্যে একাধিক ক্রেডিট অ্যাকাউন্টের জন্য আবেদন করলে “হার্ড ইনকোয়ারি” হয়, যা ক্রেডিট স্কোর কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে।
৪. মিথ্যা: পুরানো ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করলে স্কোর উন্নত হয়:
সত্যতা: পুরানো বা অব্যবহৃত ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করলে ক্রেডিট ইতিহাসের দৈর্ঘ্য কমে, যা স্কোরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৫. মিথ্যা: কম ক্রেডিট স্কোর থাকলে ঋণ পাওয়া যায় না:
সত্যতা: কম ক্রেডিট স্কোর ঋণের বিকল্পগুলো সীমিত করতে পারে, কিন্তু ঋণ পাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। ক্রেডিট স্কোর ছাড়াও অন্যান্য বিষয়, যেমন আয় ও সম্পত্তি, বিবেচনা করা হয়।
ক্রেডিট স্কোর উন্নত করার মূল উপায়:
ক্রেডিট স্কোর উন্নত করতে এবং আর্থিক সিদ্ধান্তে সফলতা অর্জন করতে নিম্নলিখিত মূল বিষয়গুলো বোঝা এবং প্রয়োগ করা জরুরি:
১. পেমেন্ট ইতিহাস: সমস্ত ক্রেডিট অ্যাকাউন্টে সময়মতো পেমেন্ট করা ঋণদাতাদের কাছে আপনার নির্ভরযোগ্যতা প্রদর্শন করে। এটি ক্রেডিট স্কোরের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। দেরিতে পেমেন্ট বা ডিফল্ট এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. ক্রেডিট ব্যবহারের অনুপাত: এটি আপনার ব্যবহৃত ক্রেডিটের পরিমাণ এবং মোট উপলব্ধ ক্রেডিটের অনুপাত। এই অনুপাত ৩০ শতাংশের নিচে রাখা দায়িত্বশীল ক্রেডিট ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার ক্রেডিট কার্ডের সীমা ১০,০০০ টাকা হয়, তবে ৩,০০০ টাকার বেশি ব্যবহার না করাই ভালো।
৩. ক্রেডিট ইতিহাসের দৈর্ঘ্য: দীর্ঘ ক্রেডিট ইতিহাস দায়িত্বশীল ক্রেডিট ব্যবস্থাপনার প্রমাণ দেয়। পুরানো অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ না করে সচল রাখা স্কোর উন্নত করতে সহায়ক।
৪. ক্রেডিট মিক্স: ক্রেডিট কার্ড, গৃহঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ধরনের ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করার ক্ষমতা আপনার ক্রেডিট স্কোরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে, অপ্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ এড়ানো উচিত।
৫. নতুন ক্রেডিট: ঘন ঘন নতুন ক্রেডিট অ্যাকাউন্টের জন্য আবেদন করলে হার্ড ইনকোয়ারি হয়, যা আর্থিক ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয় এবং স্কোর কমাতে পারে। নতুন ক্রেডিটের জন্য আবেদন সীমিত রাখা উচিত।
ক্রেডিট স্কোরের গুরুত্ব:
ক্রেডিট স্কোর শুধু ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেই নয়, বীমা প্রিমিয়াম, ভাড়া বাড়ি পাওয়া এবং এমনকি চাকরির আবেদনেও প্রভাব ফেলতে পারে। একটি উচ্চ ক্রেডিট স্কোর ঋণের কম সুদের হার এবং ভালো শর্তাবলী নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ৭৫০-এর উপরে ক্রেডিট স্কোর থাকলে গৃহঋণ বা গাড়ির ঋণে কম সুদের হার পাওয়া যায়। অন্যদিকে, কম স্কোর থাকলে ঋণের সুদ বেশি হতে পারে বা ঋণ প্রত্যাখ্যাত হতে পারে।
ক্রেডিট স্কোর উন্নত করার ব্যবহারিক পরামর্শ:
ক্রেডিট স্কোর উন্নত করতে কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, নিয়মিত ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করে ত্রুটি বা অসঙ্গতি থাকলে সংশোধন করুন। দ্বিতীয়ত, সমস্ত বিল এবং ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করুন। তৃতীয়ত, ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স কম রাখুন এবং পুরানো অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা এড়িয়ে চলুন। এছাড়া, নতুন ক্রেডিটের জন্য অপ্রয়োজনীয় আবেদন এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করে এবং বাজেট মেনে চললে ক্রেডিট ব্যবস্থাপনা সহজ হয়।
ভোক্তাদের জন্য পরামর্শ:
ক্রেডিট স্কোর নিয়ে সঠিক তথ্য জানা আর্থিক স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ। ভোক্তাদের উচিত নিয়মিত তাঁদের ক্রেডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করা এবং ক্রেডিট স্কোর উন্নত করার জন্য সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেমন, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সীমিত রাখা, সময়মতো পেমেন্ট করা এবং অপ্রয়োজনীয় ঋণ এড়ানো। এছাড়া, আর্থিক উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করে ক্রেডিট ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে।
ক্রেডিট স্কোর নিয়ে ভুল ধারণা দূর করে এবং এর প্রকৃত কারণগুলো বুঝে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সচিন সেঠের মতে, ক্রেডিট স্কোর শুধু একটি সংখ্যা নয়, বরং আপনার আর্থিক দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন। পেমেন্ট ইতিহাস, ক্রেডিট ব্যবহার, ইতিহাসের দৈর্ঘ্য, ক্রেডিট মিক্স এবং নতুন ক্রেডিটের মতো বিষয়গুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করলে ক্রেডিট স্কোর উন্নত করা সম্ভব।
ভোক্তারা এই বিষয়ে সচেতন হলে তাঁরা ভুল সিদ্ধান্ত এড়াতে পারবেন এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারবেন। সঠিক জ্ঞান এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্রেডিট স্কোরকে শক্তিশালী করে আর্থিক স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।