পহেলগাঁও কাণ্ডের জেরে রাহুল গান্ধীর জরুরি কাশ্মীর সফর

লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা (এলওপি) এবং কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi) আজ শুক্রবার জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে সফর করছেন। গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল ২০২৫)…

Rahul Gandhi Kashmir visit

লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা (এলওপি) এবং কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi) আজ শুক্রবার জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে সফর করছেন। গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল ২০২৫) পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত একটি ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর তিনি এই সফরে যাচ্ছেন, যেখানে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এই হামলা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর কাশ্মীর উপত্যকায় সবচেয়ে মারাত্মক হামলাগুলির মধ্যে একটি, যেখানে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান শহিদ হয়েছিলেন। রাহুল গান্ধী, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি সরকারি সফরে ছিলেন, এই হামলার খবর পাওয়ার পর তড়িঘড়ি তাঁর সফর সংক্ষিপ্ত করে বৃহস্পতিবার ভোরে নতুন দিল্লিতে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনও যথাক্রমে সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন।

   

রাহুল গান্ধীর সফরের উদ্দেশ্য

কংগ্রেস সূত্র জানিয়েছে, রাহুল গান্ধী শ্রীনগরে পৌঁছে দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে অবস্থিত গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজে (জিএমসি) যাবেন, যেখানে হামলায় আহতরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি আহতদের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেবেন এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানাবেন। এই সফরের মাধ্যমে রাহুল গান্ধী হামলার শিকার পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিতে চান এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের ঐক্যের উপর জোর দিতে চান। তিনি বৃহস্পতিবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির (সিডব্লিউসি) একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে এই হামলার নিন্দা জানানো হয় এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

হামলার প্রেক্ষাপট

পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে সংঘটিত এই হামলায় জঙ্গিরা পর্যটকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায়। হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট বিনয় নরওয়াল, যিনি তাঁর স্ত্রী হিমাংশীর সঙ্গে হানিমুনে পহেলগাঁওয়ে  গিয়েছিলেন। তাঁর শেষকৃত্য হরিয়ানার কর্নালে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া, শিবমোগার বাসিন্দা মঞ্জুনাথ রাও-ও এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর পরিবারের বন্ধু দত্তাত্রেয় সরকারের কাছে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার একটি ফ্রন্ট সংগঠন, দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি লস্কর-ই-তৈবার শীর্ষ কমান্ডার সাইফুল্লাহ কাসুরি ওরফে খালিদকে এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ভারতের কঠোর পদক্ষেপ

হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস)-এর বৈঠকে ১৯৬০ সালের ইন্ডাস জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ করে। এছাড়া, আটারি ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট বন্ধ করা হয়েছে, পাকিস্তানি হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের পার্সোনা নন গ্রাটা ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা পরিষেবা তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। সমস্ত বৈধ ভিসা ২৭ এপ্রিল ২০২৫ থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বদলীয় বৈঠক

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকার একটি সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করে, যেখানে পহেলগাঁও হামলার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু উপস্থিত ছিলেন। রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে বৈঠকে অংশ নিয়ে হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং সরকারের যে কোনো পদক্ষেপে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন। রাহুল গান্ধী বলেন, “সমস্ত রাজনৈতিক দল একযোগে এই হামলার নিন্দা করেছে। বিরোধী দল সরকারকে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।”

Advertisements

কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া

কংগ্রেস দল এই হামলাকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” বলে অভিহিত করেছে। রাহুল গান্ধী জম্মু ও কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের “ফাঁকা দাবি” নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “সরকারের উচিত দায়িত্ব নিয়ে এমন বর্বর ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, তার জন্য কংক্রিট পদক্ষেপ নেওয়া।” কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরাও এই হামলাকে “নৃশংস” এবং “কাপুরুষোচিত” বলে নিন্দা জানিয়েছেন। কংগ্রেস সারা দেশে ২৫ এপ্রিল মোমবাতি মিছিলের আয়োজন করেছে, যাতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য প্রদর্শন করা হবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি

জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ এই হামলাকে “কাশ্মীরিয়তের মূল্যবোধের উপর আঘাত” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একটি সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেছেন, যেখানে একটি প্রস্তাব পাস করে হামলার নিন্দা জানানো হয় এবং অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারগুলির কাছে কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানি না করার আবেদন জানানো হয়। রাজ্যে বুধবার বন্ধ পালিত হয় এবং শ্রীনগরের ডাল লেকে শিকারা মালিকরা প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন। নিরাপত্তা বাহিনী হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

রাষ্ট্রসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভারত ও পাকিস্তানকে “সর্বোচ্চ সংযম” প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলার নিন্দা জানিয়ে ভারতের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে কথা বলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

রাহুল গান্ধীর শ্রীনগর সফর পহেলগাঁও হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের প্রতি কংগ্রেসের সমর্থনের প্রতীক। এই হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং বিরোধী দলের সমর্থন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানকে তুলে ধরেছে। তবে, শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধ করতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি