জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে তলানিতে পৌঁছেছে। ভারতের কঠোর পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে, তারা ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি (Simla Agreement) সহ ভারতের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত করার অধিকার রাখে। এই ঘোষণা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ সিমলা চুক্তি জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে নিয়ন্ত্রণ রেখার (LoC) বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ LoC-এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, যা দুই দেশের সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্ধারণ করে।
পহেলগাঁওয়েে হামলা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওয়ের বাইসারান এলাকায় সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিক নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF), যা পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রক্সি গোষ্ঠী। ভারত সরকার হামলার পেছনে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করে। এর মধ্যে রয়েছে:
• সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত: ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের যুদ্ধের মধ্যেও অক্ষুণ্ণ ছিল। ভারত এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে।
• কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস: ভারত ও পাকিস্তানের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে।
• পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার: পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
• অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: সমস্ত স্থলপথে যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে।
• SAARC ভিসা স্কিম বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা ছাড় স্কিম বাতিল করা হয়েছে, এবং ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়তে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (CCS) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং হামলার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (NSC) একটি জরুরি বৈঠক করে। বৈঠকে পাকিস্তান ঘোষণা করে যে, তারা ভারতের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বিশেষ করে সিমলা চুক্তি স্থগিত করার অধিকার রাখে, যতক্ষণ না ভারত “পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদ, লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রস্তাব লঙ্ঘন” বন্ধ করে।
পাকিস্তানের অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে:
• ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: তাৎক্ষণিকভাবে সমস্ত সীমান্ত পারাপার বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমোদন নিয়ে পারাপারকারীদের ৩০ এপ্রিল, ২০২৫-এর মধ্যে ফিরতে হবে।
• SAARC ভিসা বাতিল: শিখ তীর্থযাত্রীদের ব্যতীত ভারতীয় নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা ছাড় স্কিম বাতিল করা হয়েছে। পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয়দের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।
• আকাশপথ বন্ধ: ভারতীয় মালিকানাধীন বা পরিচালিত এয়ারলাইন্সের জন্য পাকিস্তানের আকাশপথ বন্ধ করা হয়েছে।
• বাণিজ্য স্থগিত: ভারতের সঙ্গে সরাসরি বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করা হয়েছে।
• ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার: ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার পহেলগাঁওয়েে হামলায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগকে “ভিত্তিহীন” বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভারতকে প্রমাণ পেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ভারতের চাপের কাছে পাকিস্তান মাথা নত করবে না এবং “কঠোর ও কার্যকর” প্রতিক্রিয়া দেবে।
সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে উত্তেজনা
ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ভারত সিন্ধু, ঝিলাম এবং চেনাব নদীর ৮০% জল পাকিস্তানে প্রবাহিত করে। পাকিস্তানের পক্ষে এটি ২৪ কোটি মানুষের জন্য “জীবনরেখা” বলে বিবেচিত। পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তকে “জল যুদ্ধ” হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, জল প্রবাহ বন্ধ বা দিক পরিবর্তন করা হলে তা “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে গণ্য হবে এবং তারা “জাতীয় শক্তির পূর্ণ বর্ণালী” দিয়ে এর জবাব দেবে। পাকিস্তান এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, কারণ চুক্তিটি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এবং এতে একতরফা স্থগিতকরণের কোনো বিধান নেই।
সিমলা চুক্তির তাৎপর্য
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর, যা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা এবং বাংলাদেশের সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করে, ২ জুলাই, ১৯৭২-এ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে হিমাচল প্রদেশের শিমলায় সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। চুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
• নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC): ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিরতি রেখাটিকে নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যা জম্মু ও কাশ্মীরে দুই দেশের মধ্যে বিভাজন রেখা হিসেবে কাজ করে। উভয় পক্ষ এটি একতরফাভাবে পরিবর্তন না করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
• দ্বিপাক্ষিক আলোচনা: কাশ্মীর সহ সব বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
• ভূখণ্ড ফেরত: ভারত যুদ্ধের সময় দখলকৃত ১৩,০০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি ভূখণ্ড ফেরত দেয়, তবে তুরতুক এবং চোরবাট উপত্যকার কিছু কৌশলগত এলাকা ধরে রাখে।
• বাংলাদেশের স্বীকৃতি: পাকিস্তান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
সিমলা চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির একটি মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পাকিস্তানের এই চুক্তি স্থগিত করার হুমকি LoC-এর বৈধতা এবং কাশ্মীর ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কাঠামোর উপর প্রশ্ন তুলতে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব
পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত অঞ্চলীয় অস্থিরতা বাড়াতে পারে। LoC-এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সীমান্তে সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়বে। এছাড়া, সিন্ধু জল চুক্তির স্থগিতকরণ পাকিস্তানের কৃষি এবং পানীয় জলের সরবরাহের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করবে। পাকিস্তানের বাণিজ্য ও আকাশপথ বন্ধের সিদ্ধান্ত দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভারত এখনও পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের উপর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পারস্পরিক পদক্ষেপ দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে। সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সিমলা চুক্তি স্থগিত করা মানে কাশ্মীরে নতুন করে উত্তেজনা। এটা শান্তির পক্ষে ক্ষতিকর।”
পহেলগাঁওয়েে সন্ত্রাসী হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে ফাটল ধরিয়েছে। ভারতের কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতিকে আরও স্পষ্ট করেছে। সিমলা চুক্তি স্থগিত করার পাকিস্তানের হুমকি কাশ্মীর ইস্যু এবং LoC-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। দুই দেশেরই এখন শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন, যাতে অঞ্চলীয় স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।