জাতীয় পেনশন স্কিম (NPS) বহু বছর ধরেই অবসরকালীন সঞ্চয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় ও লাভজনক বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই স্কিম একদিকে যেমন ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তপোক্ত পেনশন তহবিল গড়ে তোলে, তেমনই অন্যদিকে কর ছাড়ের সুবিধাও প্রদান করে। তবে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষিত বাজেটে আয়করের সীমা ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করায় অনেক বিনিয়োগকারীর মনে প্রশ্ন উঠেছে—এই কর ছাড়ের প্রয়োজনীয়তা থাকছে তো? এখন কি তাহলে NPS থেকে টাকা তুলে নেওয়া যেতে পারে?
এই প্রতিবেদনটিতে আমরা NPS থেকে টাকা তোলার নিয়ম-কানুন এবং নতুন আয়করের সীমা বৃদ্ধির প্রভাব বিশ্লেষণ করব।
NPS অ্যাকাউন্ট: প্রাথমিক ধারণা:
NPS মূলত দুটি ধরনের অ্যাকাউন্টে বিভক্ত—টিয়ার-১ ও টিয়ার-২। টিয়ার-১ অ্যাকাউন্টটি মূল এবং বাধ্যতামূলক, যেখানে অবসরকালীন পেনশন সঞ্চয় জমা রাখা হয়। টিয়ার-২ অ্যাকাউন্টটি একটি ঐচ্ছিক ও সহজে প্রবেশযোগ্য অ্যাকাউন্ট, তবে এটি খোলার জন্য প্রথমে টিয়ার-১ অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
টিয়ার-১ অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগকারীরা সর্বোচ্চ ৭৫% পর্যন্ত ইকুইটিতে এবং ৫% পর্যন্ত অল্টারনেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে (AIF) বিনিয়োগ করতে পারেন। টিয়ার-২ অ্যাকাউন্টে চাইলে ১০০% পর্যন্ত ইকুইটিতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
অবসর নেওয়ার সময় অর্থ উত্তোলন:
অবসর গ্রহণের সময় (৬০ বছর বয়সে) টিয়ার-১ অ্যাকাউন্ট থেকে মোট জমার ৬০% অংশ করমুক্তভাবে তুলে নেওয়া যায়। বাকি ৪০% অংশ বাধ্যতামূলকভাবে একটি অ্যানুইটি স্কিমে বিনিয়োগ করতে হয়, যেখান থেকে প্রতি মাসে পেনশন আসে।
তবে, যদি অবসরকালীন মোট টিয়ার-১ তহবিল ৫ লক্ষ টাকার কম হয়, তাহলে সম্পূর্ণ অর্থ করমুক্তভাবে একবারেই তুলে নেওয়া যায়—অ্যানুইটিতে বিনিয়োগ করার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না।
অবসর নেওয়ার আগে টাকা তোলার নিয়ম:
এনপিএস স্কিমে মধ্যবর্তী সময়ে টাকা তোলার কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে। নিম্নে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হল—
১. মৃত্যুর ক্ষেত্রে:
যদি কোনও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারী অবসর গ্রহণের আগেই মারা যান, তাহলে নমিনিকে সম্পূর্ণ অর্থ তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এখানে অ্যানুইটি কেনার বাধ্যবাধকতা থাকে না। তবে সরকারি কর্মচারীর ক্ষেত্রে নমিনিকে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যানুইটিতে বিনিয়োগ করতে হয়।
২. আংশিক উত্তোলন
টিয়ার-১ অ্যাকাউন্ট খোলার পর অন্তত তিন বছর কেটে গেলে আংশিক টাকা তোলা যায়। তবে নির্দিষ্ট কিছু কারণেই এটি করা যায়—যেমন:
- চিকিৎসার খরচ
- প্রতিবন্ধকতা
- উচ্চশিক্ষার খরচ
- বিয়ে
- বাড়ি কেনা বা নির্মাণ
- ব্যবসা শুরু করা
জীবনে সর্বোচ্চ তিনবার এই সুযোগ নেওয়া যায় এবং প্রত্যেক উত্তোলনের মাঝে কমপক্ষে পাঁচ বছরের ব্যবধান থাকা আবশ্যক। প্রত্যেকবার মোট জমার সর্বোচ্চ ২৫% পর্যন্ত তোলা যায়।
৩. প্রাক-পরিপক্ব অবসর (Premature Exit)
NPS থেকে যদি কেউ ৬০ বছরের আগে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যেতে চান, তবে অ্যাকাউন্ট খোলার অন্তত পাঁচ বছর পরে তিনি তা করতে পারেন। এক্ষেত্রে:
- ২০% পর্যন্ত অর্থ তুলে নেওয়া যায়
- বাকি ৮০% অ্যানুইটিতে বিনিয়োগ করতে হয়
তবে, যদি মোট টিয়ার-১ তহবিল ২.৫ লক্ষ টাকার কম হয়, তাহলে পুরো অর্থই একবারে তোলা যায় এবং অ্যানুইটি কেনার প্রয়োজন নেই।
নতুন করসীমা ও বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন
২০২৫ সালের বাজেটে ঘোষিত নতুন করসীমা (১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত) অনেকের মনেই প্রশ্ন তুলেছে—NPS-এ বিনিয়োগ করে কর ছাড়ের প্রয়োজনীয়তা কতটা রয়েছে? এমন অবস্থায় কেউ কেউ মনে করছেন, এই বিনিয়োগের অর্থ এখন তুলে নেওয়া যেতে পারে।
তবে NPS মূলত অবসর সঞ্চয়ের জন্যই তৈরি একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা। কর ছাড় ছাড়াও এটি ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। শুধুমাত্র কর ছাড় না থাকার কারণে তাড়াহুড়ো করে টাকা তুলে নেওয়া সব সময়ে সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত নাও হতে পারে।
বর্তমানে আয়কর সীমা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু NPS-এর গুরুত্ব তাতে কমে যায় না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষিত বিনিয়োগ, যেখানে কর ছাড়ের পাশাপাশি নিশ্চিত পেনশনের সুবিধাও রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত নিজেদের ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া।