ইমামি ইস্টবেঙ্গলের (East Bengal) এবারের ফুটবল মরসুম শুরু হয়েছিল রক্ষণভাগে শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে, এবং সেই লক্ষ্যে দলে যোগ দিয়েছিলেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার হেক্টর ইউস্তে (Hector Yuste)। ষষ্ঠ বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে দলে টানার ঘোষণায় লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, গত মরসুমে হেক্টর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের হয়ে খেলেছিলেন। সেখানে তিনি রক্ষণভাগে অটল থাকার পাশাপাশি সুযোগ বুঝে আক্রমণে উঠে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্সের জোরে মোহনবাগান একাধিক ম্যাচে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়, এমনকি লিগ শিল্ড জয়ের পথে আনোয়ার আলির সঙ্গে তিনি রক্ষণভাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কিন্তু নতুন মরসুমে মোহনবাগানের ম্যানেজমেন্ট জোসে মোলিনার নেতৃত্বে হেক্টরকে রিলিজ করে দেয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইস্টবেঙ্গল তাঁকে দলে টেনে নেয়। লাল-হলুদ ব্রিগেডের পরিকল্পনা ছিল হেক্টরের অভিজ্ঞতার উপর ভর করে রক্ষণভাগ মজবুত করে নতুন মরসুমে দাপট দেখানো। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল হোঁচট খায়। সেদিনই হেক্টর প্রথমবার লাল-হলুদ জার্সিতে মাঠে নেমেছিলেন, কিন্তু দলের পরাজয় ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এই হতাশা কাটিয়ে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) দাপট দেখানোর লক্ষ্য থাকলেও সেখানেও দলের রক্ষণভাগের দুর্বলতা বারবার সামনে এসেছে।
Also Read | বাগান ম্যাচে অনিশ্চিত কেরালার এই তারকা ফুটবলার
এএফসি টুর্নামেন্টেও দলের এই দুর্বল পারফরম্যান্স সমর্থকদের হতাশ করেছে। কলিঙ্গ সুপার কাপে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা থাকলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম ম্যাচেই ছিটকে যায় ইস্টবেঙ্গল। আর সেই ম্যাচেই লাল-হলুদ জার্সিতে নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন হেক্টর ইউস্তে। গত মরসুমে মোহনবাগানের হয়ে দুরন্ত ফর্মে থাকলেও এবার ইস্টবেঙ্গলে তিনি প্রথম থেকেই ছন্দহীন ছিলেন। নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করলেও তিনি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। এবার তিনি সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন।
হেক্টর ইউস্তে, যিনি ১৯৮৮ সালের ১২ জানুয়ারি স্পেনের কার্টাগেনায় জন্মগ্রহণ করেন, ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন স্থানীয় ক্লাব ফুয়েন্তে আলামো এবং রিয়াল মুর্সিয়ার যুব দলের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি কার্টাগেনা এফসি-তে যোগ দেন এবং ২০০৮-০৯ মরসুমে দলটিকে সেগুন্দা ডিভিশনে ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্পেনের বিভিন্ন ক্লাব যেমন উদি সালামানকা, রেসিং দে সান্তান্দার, হারকিউলিস সিএফ এবং গ্রানাডা সিএফ-এর হয়ে খেলেছেন তিনি। ২০১৪ সালে তিনি লা লিগায় গ্রানাডার হয়ে অভিষেক করেন। পরে তিনি আরসিডি মায়োর্কায় যোগ দেন এবং সেখানে নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
Also Read | বাগানের অনুশীলনে যোগদান করলেন ডেগি কার্ডোজো
২০১৭ সালে তিনি সাইপ্রাসের ক্লাব অ্যাপোলন লিমাসোল এফসি-তে যোগ দেন এবং পরে এসি ওমোনিয়ার হয়ে খেলেন, যেখানে তিনি দুটি সাইপ্রিয়ট কাপ এবং ২০২১ সালে সাইপ্রিয়ট সুপার কাপ জয় করেন। ভারতে আসার আগে তিনি উয়েফা ইউরোপা লিগ এবং ইউরোপা কনফারেন্স লিগের গ্রুপ পর্বে অংশ নিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পর তিনি দ্রুত দলের রক্ষণভাগের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠেন। তাঁর শান্তশিষ্ট খেলার ধরন, বল বিতরণের দক্ষতা এবং সেট-পিসে রক্ষণাত্মক কার্যকারিতা তাঁকে বিশেষ করে তুলেছিল।
ইস্টবেঙ্গলে তাঁর সময়টা সফল না হলেও, হেক্টরের ফুটবল ক্যারিয়ারে অভিজ্ঞতার কমতি ছিল না। ২০২৪-২৫ আইএসএল মরসুমে তিনি ১৮টি ম্যাচে ১,৩৫৪ মিনিট খেলেছেন, একটি অ্যাসিস্ট করেছেন এবং চারটি হলুদ কার্ড পেয়েছেন। তবে দলের সামগ্রিক পারফরম্যান্স এবং তাঁর নিজের ফর্ম তাঁকে পছন্দসই ফলাফল এনে দিতে পারেনি।
৩৭ বছর বয়সে হেক্টর ইউস্তে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন, তবে তাঁর ক্যারিয়ারের উত্তরাধিকার থেকে যাবে। স্পেন থেকে সাইপ্রাস, এবং সেখান থেকে ভারত—তাঁর ফুটবল যাত্রা ছিল বৈচিত্র্যময় এবং চ্যালেঞ্জে ভরপুর। মোহনবাগানের সমর্থকদের কাছে তিনি ‘স্প্যানিশ রক’ হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন, যিনি দলের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের জন্য তাঁর সময়টা হয়তো হতাশার ছিল, কিন্তু তাঁর পেশাদারিত্ব এবং প্রচেষ্টা কখনো প্রশ্নের মুখে পড়েনি।
ফুটবলের মঞ্চে হেক্টর ইউস্তের বিদায় একটি যুগের অবসান। তাঁর এই অবসরের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ফুটবল একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে হারাল, যিনি মাঠে নিজের সর্বস্ব দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি কোচিং বা অন্য কোনো ভূমিকায় ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে, তাঁর অবদান এবং স্মৃতি ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।