‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ সাফল্য! চিন প্রতিবেশি দেশে রপ্তানি হল ব্রহ্মোস

ভারতের সামরিক শক্তি এখন আর শুধু নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতের অত্যাধুনিক সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রহ্মোস…

India Delivers Second BrahMos Missile Battery to Philippines

ভারতের সামরিক শক্তি এখন আর শুধু নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতের অত্যাধুনিক সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রহ্মোস (BrahMos Missile) এখন চীনের প্রতিবেশী দেশ ফিলিপাইনে পৌঁছে গেছে। ভারত সম্প্রতি ফিলিপাইনের কাছে ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল সিস্টেমের দ্বিতীয় ব্যাটারি সরবরাহ করেছে। এই সরবরাহ ২০২২ সালে স্বাক্ষরিত ২৮০০ কোটি টাকার (৩৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) চুক্তির অংশ, যার আওতায় মোট তিনটি ব্যাটারি সরবরাহ করা হবে।

Advertisements

প্রথম ব্যাটারিটি ২০২৪ সালের এপ্রিলে এয়ারলিফ্টের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল, এবং দ্বিতীয়টি ২০২৫ সালের এপ্রিলে সমুদ্রপথে পাঠানো হয়েছে। ব্রহ্মোস মিসাইলের গতি ২.৮ ম্যাক (ধ্বনির গতির প্রায় তিন গুণ) এবং এর আঘাতের ক্ষমতা ২৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত, যা এটিকে সমুদ্রে যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর অস্ত্র করে তুলেছে। এই চুক্তি ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যা ভারতের বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা খাতে ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে তুলে ধরছে।

   

ফিলিপাইনের সঙ্গে ব্রহ্মোস চুক্তি

২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভারত এবং ফিলিপাইনের মধ্যে ২৮০০ কোটি টাকার একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির অধীনে ভারত ফিলিপাইনকে তিনটি ব্যাটারির শোর-বেসড অ্যান্টি-শিপ ব্রহ্মোস ক্রুজ মিসাইল সিস্টেম সরবরাহ করবে। এটি ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা রপ্তানি চুক্তি এবং ফিলিপাইন ব্রহ্মোস মিসাইলের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রেতা। প্রথম ব্যাটারিটি ২০২৪ সালের এপ্রিলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আইএল-৭৬ বিমানের মাধ্যমে ফিলিপাইনে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় ব্যাটারিটি ২০২৫ সালের এপ্রিলে সমুদ্রপথে সরবরাহ করা হয়েছে, এবং তৃতীয় ব্যাটারির সরবরাহ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ব্রহ্মোস মিসাইলের বিশেষত্ব

ব্রহ্মোস মিসাইল ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) এবং রাশিয়ার এনপিও মাশিনোস্ট্রয়েনিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি। এই মিসাইলটির নাম ভারতের ব্রহ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মস্কভা নদীর নাম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি ২.৮ ম্যাক গতিতে চলতে সক্ষম, যা ধ্বনির গতির প্রায় তিন গুণ। এর আঘাতের ক্ষমতা ২৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত, এবং এটি অত্যন্ত নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে।

ব্রহ্মোস মিসাইল জমিন, সমুদ্র, জলর নিচে থেকে (সাবমেরিন) এবং আকাশ থেকে (বিমান) লঞ্চ করা যায়। এটি ‘ফায়ার অ্যান্ড ফরগেট’ নীতিতে কাজ করে, অর্থাৎ লঞ্চের পর এটির আর কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না। এর নিম্ন রাডার সিগনেচার এটিকে শত্রুদের জন্য সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে। প্রধানত সমুদ্রে শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা এই মিসাইল যেকোনো নৌ-হুমকির জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

Advertisements

ফিলিপাইনের তটরক্ষায় শক্তি বৃদ্ধি

ব্রহ্মোস মিসাইল সিস্টেমের সরবরাহ ফিলিপাইনের সমুদ্রতীর রক্ষা করার জন্য ফিলিপাইনের মেরিন কর্পসের তটরক্ষা ইউনিটে ব্যবহৃত হবে। এটি বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী কার্যকলাপের প্রেক্ষাপটে ফিলিপাইনের সমুদ্রতটীয় নিরাপত্তাকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করবে। এই সিস্টেমে মিসাইল ছাড়াও মোবাইল লঞ্চার, রাডার সিস্টেম এবং কমান্ড-এন্ড-কন্ট্রোল ইউনিট রয়েছে, যা ফিলিপাইনের নজরদারি এবং প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। এটি দক্ষিণ চীন সাগরে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা পরিচিতি

এই চুক্তি ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ নীতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা রপ্তানির মাধ্যমে ভারত এখন আর শুধু সামরিক আমদানিকারক নয়, বরং একটি উদীয়মান প্রতিরক্ষা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের প্রতিরক্ষা রপ্তানি ২১০.৮ বিলিয়ন রুপি (২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ফিলিপাইনের ব্রহ্মোস চুক্তি একটি বড় অংশ।

ফিলিপাইনের ২১ জন নৌসেনা সদস্যকে ভারতের নাগপুরে ব্রহ্মোস সিস্টেম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের অপারেশনাল প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করেছে। এইভাবে ভারত কেবল প্রতিরক্ষা সরঞ্জামই নয়, প্রযুক্তি এবং দক্ষতাও রপ্তানি করছে।

ফিলিপাইনে ব্রহ্মোস মিসাইলের দ্বিতীয় ব্যাটারি সরবরাহ ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং বৈশ্বিক প্রভাবের প্রমাণ। এই চুক্তি কেবল ফিলিপাইনের তটরক্ষা ক্ষমতাই বাড়াবে না, বরং দক্ষিণ চীন সাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও সহায়তা করবে। ভারতের এই কৌশলগত পদক্ষেপ তার প্রতিরক্ষা রপ্তানি লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।