একটি নতুন গবেষণায় জানা গেছে, দূষিত শহুরে মাটিতে জন্মানো বুনোফুল (Urban Wildflowers) ভারী ধাতু শোষণ করে এবং তা তাদের মধুমিষ্টির মাধ্যমে পরাগায়নকারী প্রাণীদের কাছে স্থানান্তরিত করতে পারে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, হোয়াইট ক্লোভার এবং বিন্ডউইডের মতো উদ্ভিদ দূষিত মাটি থেকে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং সীসার মতো বিষাক্ত ধাতু শোষণ করে। মৌমাছিরা যখন এই বুনোফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, তখন তারা অজান্তেই এই ধাতুগুলি গ্রহণ করে।
পরাগায়নকারী প্রাণী যেমন মৌমাছি বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপেল এবং টমেটোর মতো ফসল, যা ফল ধরার জন্য পোকামাকড়ের পরাগায়নের উপর নির্ভর করে, তাদের উৎপাদনশীলতা মৌমাছির স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল। তবে, শহুরে মাটির দূষণ এই পরাগায়নকারীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শহুরে মাটির দূষণ: উৎস ও প্রভাব
গবেষকরা জানিয়েছেন, “বিশ্বব্যাপী শহরগুলির মাটিতে ধাতব দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, এবং শহরের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূষণের মাত্রা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। সিমেন্টের ধুলো, খনন কার্যক্রম এবং শিল্প কার্যকলাপ থেকে এই ধাতুগুলি মাটিতে জমা হয়।” এই গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে পরিত্যক্ত, শিল্পোত্তর ভূমিতে পরিচালিত হয়েছে। এই অঞ্চলগুলি পূর্বে লোহা ও ইস্পাত উৎপাদন, তেল পরিশোধন এবং অটোমোবাইল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, যা মাটিতে ভারী ধাতুর দূষণের কারণ বলে মনে করা হয়।
গবেষণার ফলাফল
গবেষকরা এই স্থানে জন্মানো বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে মধুমিষ্টি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন। ফলাফলে দেখা গেছে, বিভিন্ন উদ্ভিদ বিভিন্ন ধরনের এবং পরিমাণের ধাতু শোষণ করে। এই ভিন্নতা উদ্ভিদের প্রজাতি-নির্দিষ্ট কৌশল যেমন ধাতু এড়ানো, ডিটক্সিফিকেশন এবং জৈব রাসায়নিক সহনশীলতার উপর নির্ভর করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, “নীল ফুলের চিকোরি উদ্ভিদ (Cichorium intybus) সর্বাধিক মোট ধাতু শোষণ করেছে, তারপরে হোয়াইট ক্লোভার (Trifolium repens), ওয়াইল্ড ক্যারট (Daucus carota) এবং বিন্ডউইড (Convolvulus arvensis)।”
পরীক্ষিত নমুনাগুলিতে সীসা সর্বাধিক পরিমাণে পাওয়া গেছে, তারপরে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এবং আর্সেনিক। আশ্চর্যজনকভাবে, সাধারণ ড্যান্ডেলিয়ন (Taraxacum officinale) ধাতু শোষণে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা দেখায়নি, যা ইঙ্গিত করে যে এই উদ্ভিদের মধুমিষ্টিতে ধাতু স্থানান্তর সীমিত করার স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। পৃথকভাবে, কমন মিল্কউইড (Asclepias syriaca) সর্বাধিক আর্সেনিক শোষণ করেছে, ওয়াইল্ড ক্যারটে সর্বাধিক ক্যাডমিয়াম, চিকোরিতে সর্বাধিক ক্রোমিয়াম এবং হোয়াইট ক্লোভারে সর্বাধিক সীসা পাওয়া গেছে।
মৌমাছির স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, মধুমিষ্টির মাধ্যমে ভারী ধাতু গ্রহণ মৌমাছির স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি তাদের জনসংখ্যা হ্রাস করে এবং মৃত্যুর হার বাড়ায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, “এমনকি মধুমিষ্টিতে কম মাত্রার ধাতুও দীর্ঘমেয়াদে মৌমাছির শিক্ষা ও স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, যা তাদের খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।” এই প্রভাব পরাগায়নকারীদের কার্যকারিতা হ্রাস করে, যা খাদ্য উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষকদের পরামর্শ
গবেষণার প্রধান লেখক সারাহ স্কট, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষক, বলেন, “মৌমাছিদের খাদ্য উৎস হিসেবে বুনোফুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আমাদের ফলাফল শহরে বুনোফুল রোপণে কাউকে নিরুৎসাহিত করবে না।” তবে, তিনি শহুরে মাটির গুণমান এবং পরাগায়নকারীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছেন। গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, শহরে বুনোফুল রোপণের আগে ভূমির ঐতিহাসিক ব্যবহার মূল্যায়ন করা উচিত, যাতে দূষণের ঝুঁকি কমানো যায়।
পরাগায়নকারীদের হ্রাস: একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ
গবেষণায় বন্য পরাগায়নকারীদের জনসংখ্যা হ্রাসের উদ্বেগজনক প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। গত ৫০ বছরে তাদের সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কীটনাশকের ব্যবহার এই হ্রাসের প্রধান কারণ। বিশেষ করে, ফুল সমৃদ্ধ আবাসস্থলের ক্ষতি পরাগায়নকারীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
এই গবেষণা শহুরে মাটির দূষণ এবং পরাগায়নকারীদের স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তুলে ধরেছে। বুনোফুল যদিও মৌমাছিদের জন্য অপরিহার্য খাদ্য উৎস, তবে দূষিত মাটিতে জন্মানো ফুলগুলি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। শহুরে পরিবেশে বুনোফুল রোপণের আগে মাটির গুণমান পরীক্ষা এবং ড্যান্ডেলিয়নের মতো ধাতু-প্রতিরোধী উদ্ভিদ নির্বাচনের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। পরাগায়নকারীদের সুরক্ষা এবং টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করতে এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।