“চিনের পণ্য বয়কট করতে হবে, ভারতকে আত্মনির্ভর হতে হবে”—এমনই জোরালো বার্তা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২০ সালে, করোনা অতিমারির সময়। সেই সময় গোটা দেশজুড়ে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ (Atmanirbhar Bharat) অভিযানে গর্জে উঠেছিল ভারত সরকার। দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়। চিনা অ্যাপ ব্যান, চিনা সংস্থার প্রকল্পে নিষেধাজ্ঞা—সব মিলিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল চিনের দিকে।
এই পথে হাঁটেন রাজ্য রাজনীতির নেতারাও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি চিনা পণ্য বর্জনের পক্ষে অবস্থান নেন। ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে তিনি ট্যাব দেওয়ার বদলে সরাসরি আর্থিক সহায়তার পথ বেছে নেন, যাতে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা চিনা ডিভাইসের প্রতি নির্ভরশীল না হয়।
Also Read |মে-জুনের তীব্র গরমে ভারতের শীতল জায়গাগুলোতে ঘুরে আসুন নিশ্চিন্তে
কিন্তু চার বছর পেরিয়ে এলেও বাস্তব ছবি বলছে ভিন্ন কথা। ভারত-চিন বাণিজ্যের পরিসংখ্যান জানলে অবাক হতে হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারত চিন থেকে আমদানি করেছে ১১৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। অপরদিকে চিনে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ১৪.৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৯৯.২ বিলিয়ন ডলার, যা সম্পূর্ণভাবে চিনের পক্ষে ভারসাম্যহীন।
এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে, ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্ন এখনও বাস্তবে রূপ পায়নি। বরং দিন দিন ভারতের চিনা পণ্যের উপরে নির্ভরতা বেড়েছে। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, সৌর প্যানেল, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল—চিনের থেকে এই সমস্ত পণ্যের আমদানি এখনও বিশাল অঙ্কে হয়ে চলেছে।
তাহলে প্রশ্ন উঠছে—কোথায় গেল আত্মনির্ভরতার বার্তা? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধুমাত্র ঘোষণায় নয়, বাস্তব উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে এই নির্ভরতা কমানো সম্ভব নয়। ভারতের অনেক ছোট ও মাঝারি শিল্প এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যেখানে তারা চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।
Also Read | মার্কিন মন্দার আশঙ্কায় পড়ছে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা
তাছাড়া চিনের উৎপাদন খরচ কম, স্কেল বিশাল, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পণ্যদ্রব্যের দাম অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। ফলে অনেক ভারতীয় সংস্থা, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত খাতে, চিনা পণ্য বা কাঁচামাল ব্যবহার ছাড়া বিকল্প দেখছে না।
বাণিজ্য ঘাটির এই বিপুল অঙ্ক ভারতের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। একদিকে, দেশীয় মুদ্রার উপর প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে, ভারসাম্যহীন আমদানি-রপ্তানির ফলে দেশীয় শিল্পক্ষেত্রের বিকাশে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
সরকার ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেন্টিভ’ (PLI) স্কিম সহ একাধিক নীতি এনেছে দেশীয় শিল্পকে চাঙ্গা করতে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে ধীর গতিতে। এখনও ভারতের অনেক প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প চিনা কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল।
Also Read | বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের বিয়ে ঘিরে রাজনৈতিক চর্চা তুঙ্গে
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বার্তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি কার্যকরী পদক্ষেপ। শুধু “চিনা পণ্য বর্জন” বলেই হবে না, বরং দেশীয় শিল্পের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, গবেষণায় উৎসাহ এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।
নরেন্দ্র মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্বপ্ন এখনও বাস্তব থেকে অনেক দূরে। চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে হলে ভারতকে কৌশলগত দিক থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। না হলে এই বাণিজ্য ঘাটতি শুধু বাড়তেই থাকবে, আর “আত্মনির্ভরতা” থেকে যাবে শুধুই রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ।