মুর্শিদাবাদ (Murshidabad) জেলায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এর বিরোধিতায় সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। রবিবার তিনি বলেন, রাজ্যে বিজেপি সরকার গঠিত হলে এই ধরনের হিংসার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মজুমদার অভিযোগ করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ “বাংলাদেশের লাইট ভার্সনে” পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও কঠোর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার আশ্বাস দিয়েছেন এবং সতর্ক করেছেন যে কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া হবে না।
Murshidabad Violence: বিজেপির অভিযোগ
সুকান্ত মজুমদার বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পর মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে, তবে এখনও এমন নয় যে হিন্দুরা মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারছেন। যারা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে মালদহে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছেন, তারা এখনও ফিরতে প্রস্তুত নন।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের লাইট ভার্সনে পরিণত করতে সফল হয়েছেন। বাংলার হিন্দুরা বুঝে গিয়েছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোষণ নীতি রাজ্যকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।” মজুমদার কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, যারা মুর্শিদাবাদে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
মজুমদার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিকভাবে লড়াই করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে লড়তে হবে। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, বিজেপি সরকার গঠিত হলে এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এমন আইন আনব যাতে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘর ধ্বংসকারী দাঙ্গাবাজদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হিন্দুদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। যদি কেউ ধর্মীয় স্থান থেকে হিংসা উস্কে দেয়, সেই স্থান বন্ধ করে দেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার এই ধরনের আইন আনলে বিজেপি বিধায়করা তা সমর্থন করবেন।
রাজ্যপালের বার্তা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রবিবার এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “যারা দুষ্কৃতী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক, তাদের বুঝতে হবে কাউকে আইন হাতে তুলে নিতে দেওয়া হবে না।” তিনি জানান, রাজভবনের কোর গ্রুপ মুর্শিদাবাদ এবং অন্যান্য হিংসা-কবলিত এলাকার পরিস্থিতি রিয়েল-টাইমে পর্যবেক্ষণ করছে। বোস বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। বিএসএফ এবং স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে আমরা পরিস্থিতির রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি।” তিনি কঠোর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় বিক্ষোভের সময় সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এই ঘটনায় ১৫০ জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুটি এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন ও হাইকোর্টের নির্দেশ
শনিবার কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ মুর্শিদাবাদে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয়। এই হিংসায় এখনও পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আদালত রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে পরিস্থিতির বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, এবং মামলার পরবর্তী শুনানি ১৭ এপ্রিল নির্ধারিত হয়েছে। ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ গত ৮ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার আলোচনার পর রাজ্যসভায় এই বিল ১২৮-৯৫ ভোটে পাস হয়।
বিজেপির কঠোর সমালোচনা
পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আর্মড ফোর্সেস (স্পেশাল পাওয়ার্স) অ্যাক্ট (এএফএসপিএ) জারির দাবি জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর লক্ষ্যবস্তু করে হিংসা চালানো হচ্ছে এবং রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। মজুমদার বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অযোগ্যতার কারণে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে। হাইকোর্টের রায় তাঁর শাসনের উপর একটি বড় চপেটাঘাত।”
মমতার অবস্থান
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ আইন কার্যকর করা হবে না। তিনি বলেন, “এই আইন কেন্দ্রীয় সরকার করেছে, আমরা নই। তাই এর জন্য কেন্দ্রের কাছে জবাবদিহি চাওয়া উচিত। আমরা এই আইন সমর্থন করি না। তাহলে এই হিংসার কারণ কী?” তিনি শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান। তবে, বিজেপি অভিযোগ করেছে, মমতার তোষণ নীতি এই হিংসার জন্য দায়ী।
পরিস্থিতির প্রভাব
মুর্শিদাবাদের হিংসার ফলে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে নিরাপত্তার জন্য মালদহে পালিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান এবং সুটিতে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত এবং ১৪৪ ধারা জারি থাকায় স্থানীয় জনজীবন এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
মুর্শিদাবাদের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির জটিলতা তুলে ধরেছে। সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ এবং রাজ্যপালের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও, শান্তি ফিরিয়ে আনতে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং বিজেপির মধ্যে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান, গুজবে কান না দিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহযোগিতা করা।