মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলার অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর রানার (Tahawwur Rana) ভারতে প্রত্যর্পণের পথ এখন প্রায় পরিষ্কার। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট মুম্বই হামলার এই অভিযুক্তের প্রত্যর্পণে স্থগিতাদেশ চেয়ে দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। এই রায়ের পর তাহাউর রানাকে ভারতে আনার পথ আরও সহজ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৬৪ বছর বয়সী এই কানাডিয়ান নাগরিক বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলেসের মেট্রোপলিটন ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি রয়েছেন এবং প্রত্যর্পণ রুখতে নানা কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন।
তাহাউর রানা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের অ্যাসোসিয়েট জাস্টিস এবং নবম সার্কিটের সার্কিট জাস্টিস এলেনা কাগানের কাছে একটি জরুরি আবেদন জমা দিয়েছিলেন। এই আবেদনে তিনি তার বিরুদ্ধে চলমান হেবিয়াস কর্পাস মামলার রায়ের উপর স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন। গত মাসের শুরুতে জাস্টিস কাগান তার এই আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর রানা পুনরায় একটি নতুন জরুরি আবেদন দাখিল করেন এবং অনুরোধ করেন যে এটি প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের কাছে পাঠানো হোক। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তার এই নতুন আবেদনটি ৪ এপ্রিল আদালতের কাছে পেশ করা হয়। সোমবার সুপ্রিম কোর্ট একটি নোটিশের মাধ্যমে জানায় যে এই আবেদনটিও খারিজ করা হয়েছে।
তাহাউরের কৌশল ব্যর্থ
এর আগে তাহাউর রানা ভারতে প্রত্যর্পণ থেকে বাঁচতে নতুন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে একটি জরুরি আবেদন দায়ের করে তার প্রত্যর্পণে স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিম হওয়ায় ভারতে তার উপর নির্যাতন চালানো হবে। এছাড়া তিনি তার স্বাস্থ্যের খারাপ অবস্থার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। তবে, তার এই যুক্তি আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
‘পাকিস্তানি মুসলিম হিসেবে ভারতে নির্যাতনের শিকার হবো’
তাহাউর রানা তার আবেদনে জানিয়েছিলেন যে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিম হওয়ার কারণে ভারতে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হবে। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে তার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে ভারতীয় কারাগারে তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না। তবে, আমেরিকান আদালত তার এই যুক্তি আমলে নেয়নি এবং তার প্রত্যর্পণের পথে কোনও বাধা রাখেনি।
আমেরিকার সমর্থন ও প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া
তাহাউর রানা ২৬/১১ হামলার অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি-আমেরিকান জঙ্গি ডেভিড কোলম্যান হেডলির ঘনিষ্ঠ সহযোগী। গত মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রানার প্রত্যর্পণের অনুমোদন দেয়। এর আগে জানুয়ারি মাসে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রানার প্রত্যর্পণে সম্মতি জানিয়েছিল, যখন তারা তার পর্যালোচনা আবেদন খারিজ করে দেয়। ভারত গত মাসে জানিয়েছিল যে তারা তাহাউর রানাকে দ্রুত প্রত্যর্পণের জন্য আমেরিকান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছিলেন, “২১ জানুয়ারি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্তের আবেদনের শুনানি করতে অস্বীকার করে। আমরা এখন মুম্বই জঙ্গি হামলার এই অভিযুক্তকে দ্রুত ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য আমেরিকার সঙ্গে প্রক্রিয়াগত বিষয়ে কাজ করছি।”
২৬/১১ মুম্বই হামলার ভয়াবহতা
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ১০ জন পাকিস্তানি জঙ্গি আরব সাগরের সমুদ্রপথে ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বইয়ে প্রবেশ করে একটি রেলওয়ে স্টেশন, দুটি হোটেল এবং একটি ইহুদি কেন্দ্রে হামলা চালায়। প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে চলা এই হামলায় ১৬৬ জন নিহত হয়েছিলেন, যা গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। হামলার পর একমাত্র জীবিত ধরা পড়া জঙ্গি অজমল আমির কসাবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে ২০১২ সালের নভেম্বরে পুনের য়েরওয়াড়া জেলে কসাবকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
তাহাউর রানার প্রত্যর্পণ ভারতের জন্য একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তিনি মুম্বই হামলার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ। তার সহযোগী ডেভিড হেডলি হামলার আগে মুম্বইয়ে এসে রেকি করেছিলেন এবং রানা তাকে সহায়তা করেছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে রানার প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়ে আসছিল এবং এই রায়ের মাধ্যমে সেই দাবি পূরণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের ফলে তাহাউর রানার প্রত্যর্পণ এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ভারতীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি তার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত। এই ঘটনা ভারত-আমেরিকার মধ্যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। ২৬/১১ হামলায় নিহতদের পরিবার এবং দেশবাসী এখন ন্যায়বিচারের আশায় রয়েছেন।