ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি প্রভাবশালী শক্তি হলেও, সামাজিক ব্যবহার (Social Practice) ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। কেরল, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গ—এই তিন রাজ্য তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সমতা এবং জনকল্যাণে অসাধারণ সাফল্যের জন্য পরিচিত। এই রাজ্যগুলো বর্তমানে বামপন্থী, ডিএমকে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনাধীনে রয়েছে। এদের সামাজিক ব্যবহারের ধরন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।ইন্ডিয়া টুডের একটি সমীক্ষায় এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
কেরল: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অগ্রগামী
কেরল, যেখানে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) শাসন করছে, সামাজিক ব্যবহারে সর্বদা শীর্ষে থেকেছে। এই রাজ্যের সাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। বামপন্থী সরকার শিক্ষার প্রসারে বিনিয়োগের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। কোভিড মহামারীর সময় কেরলের দ্রুত সাড়া, বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। নিম্ন শিশু মৃত্যুহার এবং উচ্চ আয়ুষ্কাল কেরলের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ। এখানকার জনগণ সরকারি নীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়, যা একটি শক্তিশালী সম্প্রদায় চেতনা গড়ে তুলেছে।
তামিলনাড়ু: সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক উন্নতি
তামিলনাড়ুতে দ্রাবিড় মুন্নেত্র কড়গম (ডিএমকে) শাসনের অধীনে সামাজিক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সুষম মডেল গড়ে উঠেছে। এই রাজ্যের সাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশের বেশি এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। তামিলনাড়ুতে সরকারি হাসপাতালগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের চিকিৎসা প্রদান করে। ডিএমকে সরকার নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে বিশেষ জোর দিয়েছে, যার ফলে রাজ্যে নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বেড়েছে। এছাড়া, জাতিগত সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য দ্রাবিড় আন্দোলনের ঐতিহ্য তামিলনাড়ুকে একটি প্রগতিশীল সমাজে রূপান্তরিত করেছে। এই রাজ্যের জনগণের সামাজিক সচেতনতা ও সরকারের প্রতি দায়বদ্ধতা চোখে পড়ার মতো।
পশ্চিমবঙ্গ: সংস্কৃতি ও জনকল্যাণের মিশ্রণ
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) শাসনের অধীনে সামাজিক ব্যবহারে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। এই রাজ্যে শিক্ষার হার ৭৭ শতাংশের বেশি এবং স্বাস্থ্যসেবায় জনকল্যাণমূলক প্রকল্প যেমন ‘স্বাস্থ্য সাথী’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গ্রামীণ উন্নয়ন ও নারী ক্ষমতায়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের মতো কর্মসূচি মেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক সংহতি এখানকার জনগণের ব্যবহারে প্রতিফলিত হয়।
তিন রাজ্যের সাফল্যের কারণ
কেরল, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ব্যবহারে শীর্ষে থাকার পিছনে রয়েছে তাদের শাসক দলগুলোর জনকেন্দ্রিক নীতি। কেরলে বামপন্থী সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে সমাজের গোড়া শক্তিশালী করেছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে দ্রাবিড় আন্দোলনের ঐতিহ্য ধরে সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভারসাম্য রক্ষা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি সংস্কৃতি ও জনকল্যাণের মিশ্রণে একটি সমন্বিত সমাজ গড়ে তুলেছে। এই তিন রাজ্যই প্রমাণ করে যে, সামাজিক ব্যবহারের উন্নতি রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও জনগণের অংশগ্রহণের উপর নির্ভরশীল।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এই তিন রাজ্যের দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষার প্রসার এবং স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। যেখানে কেরলের উচ্চ আয়ুষ্কাল ৭৫ বছরের বেশি, তামিলনাড়ুতে শিশু মৃত্যুহার জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য বীমা ও শিক্ষা সহায়তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই তিন রাজ্যের সরকারই জনগণের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই তিন রাজ্যের সামাজিক ব্যবহার ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবিজেপি শাসিত এই রাজ্যগুলোর মডেল জাতীয় স্তরে প্রয়োগ করা গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তবে, চ্যালেঞ্জও রয়েছে—অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়ে আরও কাজ করতে হবে।
কেরল, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রমাণ করে যে, সামাজিক ব্যবহারের শীর্ষে থাকতে রাজনৈতিক দলের চেয়ে নীতি ও জনগণের অংশগ্রহণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই তিন অবিজেপি শাসিত রাজ্য ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজে সমতা ও উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরেছে।